রেললাইনের দুপাশ সারি দিয়ে পুকুর। একসময় রেললাইন উঁচু করার জন্য দুধার থেকে মাটি কেটে লাইনে ফেলা হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে জল জমে এখন তা রীতিমতো পুকুর। রেলপুকুর শেষ হলে দুটো একটা নারকোল কি সুপুরি গাছ। তার পেছনে সার দিয়ে জননবসতি। একতলা দোতলা বাড়ী, বাড়ীর ছাদে অ্যান্টেনা, বাড়ীর পাশে লেভেল ক্রসিং, মুদীখানা। ছোট ছোট জনপদ। শহরতলী। মধ্যবিত্ত মানুষজনের মাথা গোঁজার ঠাঁই।
সিদ্ধার্থ জানালার ধারে বসে কাস্তে হাতুড়ী গুনছিল। তার উল্টোদিকে একটা চিমড়ে মার্কা লোক বসে। হাতের কনুইয়ে পুঁজ। ফুটিফাটা জামা। লুঙ্গির ট্যাঁকে হলদেটে কাপড়ের পুঁটলি মত। কোমরে গামছা বাঁধা কান্নিক। রাজমিস্ত্রী বোধহয়। কাজকর্ম সেরে হয়তো বাড়ী ফিরছে। পাশে ময়লা কাপড়ের ব্যাগ রাখা। একটু পরে সেখান থেকে একঠোঙা মুড়ি বের করে লোকটা একমনে চিবুতে লাগল।
সিদ্ধার্থ একটু বিরক্ত বোধ করল। সে একটা দুঃসাহসিক কাজ করতে চলেছে। কোথায় একটু লো আঙ্গেল থেকে ক্যামেরা শট্টা নেবে, হালকা জুম করে চোখের ঘোলাটে দৃষ্টির দিকে প্যান করবে, সাথে ভেসে আসবে হালকা উন্মাদক সুর, তা না খালি মুড়ি চিবোনোর কচর মচর শব্দ শুনতে হচ্ছে। এ লোকটার কাছে জীবন মানে হচ্ছে এই নৈহাটি লোকালে জানালার ধারের কচরমচর। উঁহু, একটু উদাস সুর আনতে হলে মুখের সামনে এই উপদ্রবটিকে বরদাস্ত করা চলবে না।
সিদ্ধার্থ উল্টোদিকের জানালার ধারে এসে বসল। এদিকটায় চড়া রোদ। সামনের সীটে পায়ের ওপর পা রেখে সে চেষ্টা করল একটু আয়েশ করার। বাইরে নিস্তব্ধ দুপুরে আলোর বন্যায় ভাসছে ইঁট কাঠ পাথর। সিদ্ধার্থ দেখল, এধারের রেলপুকুরের জলে ছায়া পড়েছে। হাঁস চরছে। বিস্রস্তবসনা হয়ে কেউ পুকুর ঘাটে আছাড়ি দিয়ে কাপড় কাচছে। পাশে কঞ্চিপাতা ঝোপের পাশে শুকনো ঘুঁটের সারি। পায়ে হাঁটা রাস্তার পাশে পানপরাগের প্যাকেট। রেলপুকুরের পাশে দোতলা বাড়ির বারান্দায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। লাফঝাঁফ দৌড়োদৌড়ি চীৎকার। দূরে একরঙা সারি সারি ফ্ল্যাট। টেলিফোন অফিস। বাড়ীর ছাদে মোবাইল টাওয়ার। পায়রা উড়ছে, পায়রা নামছে। স্টীল লাইফ। স্ন্যাপশট্স। ফাইভ কি সিক্স ফ্রেমস পার সেকেন্ড। মিঠে ঘটাং ঘট শব্দ তুলে রেললাইনরা বুড়ি ছুঁয়ে পালিয়ে যায়।
সেও পালাতে পারত। বনামীকে ভালবাসে না সে? তুমুল দায়বদ্ধতার কাছে মাথা নীচু করে দিব্যি সরে আসতে পারত। চতুষ্পদরা যেমন এক ঝটকায় জল ঝেড়ে ফেলে, তেমন করে। তার বদলে এই বুড়ি ছোঁয়ার ইচ্ছেটুকুকে এত আমল দেবার কারণ কী? চেষ্টা করেও তো খুঁটি উপড়ানো যাবে না।
সিদ্ধার্থ চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করল অন্য স্পেস টাইম কার্ভেচারের প্যারালাল ইউনিভার্সে তার কাউন্টার পার্ট কি ভাবছে এই সময়। সেও কি চড়ে বসেছে নৈহাটি লোকাল? তারও কি গন্তব্য এক? তার বনামীও কি একই রকম পজেসিভ, বাংলা অনার্স এবং নাকিকান্না সিরিয়াল টাইপ?
ফের দ্বিধা। মনের ভেতর থেকে থেকে যাবতীয় নীতিকথা বোধ ধাক্কা মারছে। ইস্ তুমি না কমিটেড। সুনির্দিষ্ট লজিক্যাল রিজনিং মেনে চলা কর্তব্যনিষ্ট পুরুষ। অজানা অভিসারের অনুমতির প্রশ্নটাই তো অর্থহীন। ডেডিকেশন কই সিদ্ধার্থ? ডেডিকেশন?
ট্রেনটা ট্রাক চেঞ্জ করল। গতিও কমল মনে হচ্ছে। কোন স্টেশন আসছে কী? হ্যাঁ সোদপুর। সবুজ বেড়া দেওয়া প্ল্যাটফর্ম। গুটিকয়েক লোক, শেডের তলায় উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে। স্টেশনে চায়ের স্টলের শাটার খুলছে কয়েকজন। মৃদু হাওয়ার সাথে অচেনা পাখির হু হু ডাক। নিঝুম দুপুরযাত্রায় আর বাকী মাত্র কয়েকটা স্টেশন। সিদ্ধার্থ টানটান হয়ে বসল।
নিজেকে বোঝানোর মতো কিছু এক্সকিউজ দরকার। এই অদ্ভুত ঝড়ের মূলে তৈরী হওয়া বাটারফ্লাই এফেক্টটা আসলে কী? খেয়াল খুশি আদিখ্যেতা? শ্রবণার কাছে ঘেঁষার প্রতি মোহ? নাকি সিদ্ধার্থ বসু সেইসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করছে যার ব্যাখ্যা তাবড় মনস্ত্বত্ববিদদের নাগালের বাইরে। এই দিনের, এই ঘটনার অভিজ্ঞান হিসেবে সে কোনটিকে মনে রেখে দেবে?
বাড়ী ঘর দোর হুহু করে ছুটে আসছে। পড়ন্ত দুপুরে রোদ নেমে এসেছে মাটির কাছে। নানান ফাঁকফোঁকর দিয়ে আলো এসে উথলে উঠছে সিদ্ধার্থের চোখে মুখে, হাতের চামড়ায়। চোখ বুজে রোদ মাখতে লাগল সে। মনের ভেতর মনের সাথে ঝগড়া চলুক, সে না হয় লজ্জা গুলো অন্যখানে পোষমানাবে।
আরো একটা স্টেশন ছুটে এল। সেই একই সবুজ বেড়া, ফ্যাকাশে শেডের চাল, চায়ের স্টল, খবরের কাগজের সারি। তবে এটা আরো নির্জন। স্থির প্ল্যাটফর্মে বড় সাবেকি ঘড়িখানা খালি সময় বহন করে চলেছে। বাতাসে অনাঘ্রাতা গন্ধ।
সিদ্ধার্থ জানালা দিয়ে উঁকি মেরে স্টেশনের নামটা দেখার চেষ্টা করল। হিসেবি মতে ঠিক এর পরেরটাই হল তার গন্তব্য। ই টি এ ফাইভ মিনিট্স।
স্টেশনের পেছনেই ছোট কোয়াটার মতন। টিনের চালাঘর। বাইরে জল খাবার পাইপ ও কল। বারান্দায় সুখী ঘরের কাপড়চোপড় ঝোলানো। তীব্র অসুখী চোখে সেদিকে তাকাতেই সিদ্ধার্থ লক্ষ্য করল একটি বৃদ্ধ বলিরেখা সম্পন্ন কোলকুঁজো চেহারা বারান্দায় বসে ঝিমোচ্ছে।
কতক্ষণ ট্রেন থামে এখানে? একমিনিট, দুমিনিট? সিদ্ধার্থর মনে হল, সে যেন অনন্তকাল ধরে এখানে থেমে আছে। চারিদিক কি ভীষণ রকম শান্ত। ট্রেনের ভেতরকার মুড়িজাত কচরমচর বহুক্ষণ আগে থেমে গেছে। গুবগুবি পাখির ডাক বেয়ে আলটপকা গরম বাতাস এসে লাগছে মুখে। লাইনের ওপর পড়ে থাকা ইতস্ততঃ প্লাস্ট্যিকের কাপ ছড়ানো ছিটোনো। সিদ্ধার্থ উষ্ণতার খোঁজে বুড়োটার দিকে তাকাল।
নিরীহ ঝুঁকে পড়া মুখ। চোখ বোজা। গায়ে ময়লা গেঞ্জি। বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়া দেহ। টুলের ওপর কোনমতে হাত দিয়ে দেহটাকে ধরে রেখেছে। মাথায় অল্প কিছু চুল, তাও সাদা। গালে বহুদিনের না কামানো অযত্ন। রোগাটে দেহের তুলনায় মস্তিষ্ক কিছুটা বড়। অন্ততঃ ফোরহেড। চোখ বুজে কী ভাবছে ওই বুড়ো? যৌবন বয়সের কথা? নিজের ডানপিটেমোর কথা? নিজের বাপমায়ের কথা? নাকি ও স্রেফ মানসিক ভাবে বন্ধ্যা? ব্ল্যাঙ্ক জগত নিয়ে স্রেফ মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষারত।
ট্রেন ছেড়ে দিল।
সহসা, অনুভূতিটা গাঢ় হল। রোম খাড়া হওয়া শিরশিরানি নামল শিরদাঁড়া জুড়ে। বহুযুগ পরে কোন এক দুপুর বিকেলে সেও তো বসে থাকবে এমনি ভাবে কোন টুলের ওপর। জরাগ্রস্ত। তার মাথায় থাকবে হয়তো কিছু অল্প সাদা চুল, গালে থাকবে বহুদিনের না কামানো দাড়ি। কোনমতে দেহটাকে বাঁচিয়ে রাখবে সে চরম মুক্তি থেকে। সেই সময় বলিরেখা জড়ানো মুখে কোন চিন্তার জপমালা গুনতে হবে তাকে? কি ভাববে সে সেইসময়? কোন অমূল্য গোপন স্মৃতির বয়াম খুলে সন্তপর্নে বার করবে রুপোলী জিয়নকাঠি? চোখ বুজে ঢুলে ঢুলে পড়ে যাওয়ার আগের মুহূর্ত অবধি যে লুকোনো ট্রেজার তাকে নিশ্চিত মৃদুভাবে ছুঁয়ে থাকবে।
সিদ্ধার্থ বসু উঠে দাঁড়ালো। ট্রেন ছুটে চলেছে। আর বড়জোর কয়েক মিনিট। তারপর স্বাভাবিক মন্দন শুরু হবে। ফের ফ্রেমে উঠে আসবে হয়তো একই রকম সবুজ বেড়ার স্টেশন। তারপর হয়তো শুরু হবে নিজেকে সরিয়ে রেখে নিজেকে দেখা। শ্রবণার সাথে দেখা হোক বা নাই হোক, উদ্দিষ্টের দিকে সে একাই হেঁটে যাবে। প্রানপণে মনে রেখে দেবে সমস্ত পদক্ষেপ। বদলে যাওয়া চিত্রপট। সে নির্ধারিত করবে তার বৃদ্ধ বয়েসের ‘আফটারনুন ড্রিম’। সিদ্ধার্থ বসু তার ভবিষ্যতের প্রত্যেকটি দুপুর কে শনাক্ত করে ফেলবে পরবর্তী কিছু সময়ে।
ট্রেনের গতি কমে এসেছে। সিদ্ধার্থ সামান্য টলতে টলতে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। সবুজ বেড়ার প্ল্যাটফর্ম ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। বৃথাই সে এতক্ষণ নিজের সাথে ঝুঝছিল। প্রত্যকের দরকার থাকে একটা গোপন অপরাধবোধ। শেষজীবনের রোমন্থনের রসদ। প্রতিটা মানুষ তার নিজস্ব সবুজ খাতায় লিখে রাখে এ রসদের প্রতিটি হিসেব। সেই বা ছুঁড়ে ফেলে দেবে কেন এ অযাচিত বাটারফ্লাই এফেক্ট?
ট্রেন থেমেছে। সিদ্ধার্থ অনুভব করল, তার দেহের প্রতিটি বিন্দুতে কোয়ান্টাম স্পুকি এফেক্ট। আইনস্টাইন বোকা ছিলেন। একপশলা উদ্দাম হাওয়ার সাথে সে টের পেল, প্যারালাল ইউনিভার্সে তার কাউন্টারপার্টটিও নৈহাটি লোকালের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
মৃদু হেসে, আমাদের গল্পের নায়ক সিদ্ধার্থ বসু সবুজ বেড়ার প্ল্যাটফর্মে নেমে এল।
No comments:
Post a Comment