Showing posts with label গল্প. Show all posts
Showing posts with label গল্প. Show all posts

Saturday, 17 December 2011

বব উইলিস ও একটি কালো কোটের গল্প- শেষ পর্ব

     শীতের রাতের জর্জটাউনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানকার লোকজন সব ঘরের ভেতর ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে পুরনো দিনের স্মৃতিচারণা করে। দূরে, গীর্জা থেকে ভেসে আসা ঘন্টাধ্বনি এবং কয়্যারের শব্দে তাদের সাধারণত মনে পড়ে নিজেদের সুখী দিনগুলোর কথা। এসব ভেবে তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবং শপথ নেয় আসন্ন বসন্তে অবশ্যই কোথাও তারা দলবেঁধে পিকনিকে যাবে।
    এই কথাগুলো বলার কারণ আমাদের গল্পের নায়ক বব উইলিস এই সমস্ত স্বাভাবিক সুখী ভাবনা ছেড়ে একটি অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল। কাজটি যে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কঠিন ও পরিশ্রমসাধ্য তাতে তার কোনো সন্দেহ ছিল না। তাই নিগ্রো বুড়োর মৃতদেহটা বস্তাবন্দী করে টেনে হিঁচড়ে রাস্তার শেষে বড় জঞ্জালের স্তূপের সামনে এনে ফেলে সে পরিতৃপ্তির হাসি হাসল।
     এই অবস্থায় তাকে কেউ দেখেনি। দেখা সম্ভবও ছিল না, কারণ জর্জটাউনের লোকেরা এত বোকাও নয় যে ঘরের ভেতর নিশ্চিন্ত আগুনের উত্তাপ ছেড়ে বরফঠান্ডা সিটিহল অ্যালির এককোণে কি হচ্ছে তার খোঁজ নেবে। হাঁফাতে হাঁফাতে বব নিজের অদৃষ্টকে গালমন্দ করছিল।
কত রাত হবে এখন? রাস্তায় জনপ্রাণী নেই। নিঝুম জর্জটাউনের অলিতে গলিতে শুধু হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ। রাত্রের নিজস্ব আলোয় দেখা যাচ্ছে বাড়ীঘরের জানালা দরজা বরফে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। হয়তো কাল সকালে রেডিওতে ওরা ঘোষণা করবে মরসুমের সবচেয়ে বেশী তুষারপাত গতকালই হয়েছে। বব লক্ষ্য করল, বরফের উপর বস্তাটাকে টেনে হিঁচড়ে আনার দাগ তৈরী হয়েছে। এতে অবশ্য সে ঘাবড়াল না কারণ সে জানে এই দাগ মুছে যেতে বেশী সময় লাগবে না।
     বস্তার মুখ খুলে সে একবার দেখল বুড়োর মুখটা। মাংসের টিনের কৌটোয় যেরকম হাস্যকর গবাদি পশুর ছবি দেওয়া থাকে ঠিক সেরকম। চোখ দু’টো এখনো খোলা। ববের মনে একটু করুণার উদ্রেক হওয়াতে সে হাত দিয়ে বুড়োটার চোখ দু’টো বুজিয়ে দিল।
—‘ঈশ্বর করুণাময়, ও আজ রাতেই মারা যেত। আমি শপথ করে বলতে পারি আমার কোনো ভূমিকা ছিল না এতে।’
স্বগতোক্তি করল বব। হঠাৎ মনে এলো বেনসনের কথা। সে নিশ্চয়ই আজ চেস্টারের পাবে ববের অপেক্ষায় ছিল। বিস্তর বোতল ওড়ানোর পর সে নির্ঘাত ববকে শাপমন্যি করে বিদায় নিয়েছে।
হাতের দস্তানাটা সামান্য টেনে নিয়ে বেশ একটু কসরত করেই বুড়োটার মৃতদেহ বস্তাটার ভেতর থেকে বের করে আনল বব। নিগ্রোটার ওভারকোটের ভেতরটা এখনো গরম। কোটখানা বেশ উঁচু মানেরই বলতে হয়। অন্তত সাধারণ গরীব নিগ্রোরা এগুলো পড়ে না। বব একটু পরখ করে দেখল।
     সময় নষ্ট করলে চলবে না, বলা যায় না টহলদার পুলিশ চলে আসতে পারে। সে যখন ঠিকই করে ফেলেছে জর্জটাউন থেকে পাকাপাকি বিদায় নেবে তখন ঝুটঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কি? তাছাড়া বেশীক্ষণ এই ঠান্ডায় থাকলে সে নিজেও কাবু হতে পারে।
বব লাশটাকে টেনে হিঁচড়ে দাঁড় করাল। তারপর কোনোরকমে পিঠে চাপিয়ে এক পা দুপা করে জঞ্জাল ফেলার বিরাট চৌকো ক্রেটটার দিকে এগোতে লাগল।
—‘এই তাহলে ব্যাপার, বব উইলিস, হলফ করে বলাই যায় তুমি আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মোটেই এই পরিস্থিতির কথা ভাবোনি।’
নিজের মনেই হেসে উঠল বব। গোটা ব্যাপারটার এরকম পরিণতি হওয়াতে সে নিজে যারপরনাই অবাক। সে ভেবেছিল নিগ্রোটার সাথে রাত্রে জমিয়ে খানাপিনা করবে।
     দেহটা ভীষণ ভারী, এবং ক্রেটটা বেশ উঁচু। সাধারণত সাফাইওয়ালারা বড়বড় ভারী যন্ত্রপাতিবোঝাই গাড়ি নিয়ে এসে ক্রেট সমেত তুলে নিয়ে যায়। ছোট ছেলেমেয়েরা যাতে ভুল করে ওর মধ্যে না গিয়ে পড়ে সেজন্য অমন উঁচু করা হয়েছে। সুতরাং, লাশটা ক্রেটটার ভেতর ছুঁড়ে ফেলতে হলে ববকে রীতিমতো কসরত করতে হবে। এবং যেহেতু সে জর্জটাউনের একজন সভ্য নাগরিক তাই সে যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলতে পারে না। বার দুই চেষ্টা করার পর বব হাঁপিয়ে পড়ল।
­—‘যীশুর দিব্যি! লোকটা এত ভারী কেন?’
কালো ওভারকোটটা এখনও বুড়োর গায়ে। বরফ কুচি পড়ে দিব্যি একটা নকশা তৈরী হয়েছে। দামী কোট। যেসব বড়লোকেরা জর্জটাউনের উত্তরে বাস করে তারা সাধারণতঃ এই জাতীয় কোট পছন্দ করে। হয়তো ওদেরই কারোর থেকে চুরি করেছে এই হতভাগা।
—‘আহা, আমি কি ভুল করছি, আমি তো এই কোটটা স্বচ্ছন্দে খুলে নিতে পারি।’
বব ঝুঁকে পড়ে ওভারকোটটা নিরীক্ষণ করতে লাগল।
—‘যদি বেঁচে থাকতে তাহলে তুমি অবশ্যই বলতে এটা তুমি কোথা থেকে পেয়েছ? হয়তো এটা আমি তোমার কাছ থেকে কিনেই নিতাম। তবে দু’ডলারের বেশি তুমি দাম পেতে না।’
বব বসে পড়ে ওভারকোটের বোতামগুলো খুলতে লাগল।
—‘এখন যেহেতু তুমি মারা গেছ, তাই তোমাকে টাকাপয়সার কথা বলে বিব্রত করতে চাইছি না। আর তাছাড়া স্বর্গ বা নরকে যেরকম ব্যবস্থা শুনেছি তাতে টাকাপয়সা নিয়ে গিয়ে বিশেষ লাভ কিছু হত না।’
ঠান্ডায় ববের আঙুলগুলো জমে আসছে। দ্রুত বোতামগুলো খোলার পর সে কোনোরকমে ওভারকোটটা উদ্ধার করল।
‘এইবার, মনে হচ্ছে আমি তোমাকে ঠিক জায়গায় নিয়ে যেতে পারব। কাল সকালে সাফাইওয়ালারা বাকিটা বুঝে নেবে’, নিগ্রোটার দিকে চেয়ে বিড়বিড় করল বব। ঠান্ডা তার শীতের পোষাক ভেদ করে হাড় অবধি পৌঁছে যাচ্ছে। নিজের প্যান্টের পকেট থেকে সে একটা ছোট্ট বোতল বার করল। এটা মিসেস হিগিন্‌সের অবদান। প্রবল শৈত্যে বব বিপদে পড়তে পারে ভেবে তিনি সরাইখানার গুদামঘর থেকে এটি সরিয়েছেন। বব একঢোঁক গলায় ঢেলে মিসেস হিগিন্‌সের উদ্দেশ্যে ধন্যবাদ জানাল।
—‘তুমি যদি আরো একটা রাত কাটাতে পারতে, তাহলে তোমাকে আমি চিংড়ীমাছের ব্যবসার অংশীদার করতে পারতুম। তবে তোমার কপাল মন্দ এটা বলতেই হয়।’
বব আর এক ঢোঁক খেল। লাশটা বরফের উপর শোয়ানো। ধীরে ধীরে বরফকুচিতে শরীরটা ঢেকে যাচ্ছে। ওভারকোটটা একপাশে রাখা।
—‘আমি চেয়েছিলাম তোমার উপকার করতে, তবে তোমার তো ব্যাপারটা মনপসন্দ হল না। তবে কি জান এই মুহূর্তে তোমার কবরের জায়গা হিসেবে এইখানটাই আমার পছন্দ। আর তোমার ওভারকোটটা আমি অবশ্যই নিয়ে নেব, কারণ তোমার খাওয়ার খরচা বাবদ মিসেস হিগিন্‌সের কাছে আমার কিছু ধার হয়েছে।’
তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে হবে। গলায় আর এক ঢোঁক ঢেলে বব বোতলটাকে পকেটে পুরলো। তারপর বুড়োর মৃতদেহটা কোনোরকমে তুলে ধরে সর্বশক্তি নিয়ে সে ছুঁড়ে দিল ক্রেটটার ভিতরে। এই বার তার প্রচেষ্টা সার্থক করে লাশটা ক্রেটটার ভিতরে গিয়ে পড়ল। হাল্কা নরম একটা আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে শিস্‌ দিয়ে উঠল বব। আপদ গেছে। চারিদিক একবার দেখে নিল সে। নাহ্‌, সিটিহল অ্যালির ভিতর জঞ্জালের স্তূপের কাছে এই ঘটনা লক্ষ্য করার মতো কেউ নেই।
     এবার যত দ্রুত সম্ভব ঘরে ফিরতে হবে। মুখ ফিরিয়ে হাঁটা শুরু করতেই ববের মনে একটু খটকা লাগল। কাজটা কি ঠিক হল? ওভারকোটটা খুলে নেওয়াটা বড় নিষ্ঠুর হল বোধহয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে একটা নিগ্রো বুড়োটার মৃতদেহ ঠিক কতখানি সম্মানের যোগ্য। যদিও একজন প্রকৃত ক্যাথলিক হিসেবে তার উচিত ছিল ওর সৎকার করা কিন্তু পাদ্রী সাহেব যে বলেন ওদের মধ্যে শয়তান বাস করে, নরকের আগুনে ক্রমাগত পোড়ে বলেই ওদের গায়ের চামড়ার রঙ কালো। সেক্ষেত্রে...
—‘হা ঈশ্বর!’
মুহূর্তের দ্বন্দ্ব কাটিয়ে বব শপথ নিল তার এই কৃতকর্মের কথা সে কাউকে জানাবে না। কেউ জানবে না বব উইলিস, জর্জটাউন কোলিয়ারীর শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা, একটা মৃত নিগ্রো বুড়োর দেহ থেকে ওভারকোট খুলে নিয়েছিল।
‘কি অদ্ভুত রাত্রি’, স্বগতোক্তি করল বব, তারপর রাস্তা থেকে ওভারকোটটা তুলে নিয়ে গায়ে চড়িয়ে সে হাঁটা দিল সরাইখানার উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে তার মনে হল জর্জটাউন আর তাকে কোনো বিস্ময় উপহার দিতে পারবে না, এ শহর এখন তার কাছে বাতিল আবর্জনার মতোই ফেলনা। শূন্য থেকে নেমে আসা রাশি রাশি তুলোর মত পেঁজা বরফের দিকে তাকিয়ে সে মনস্থির করে ফেলল হ্যামন্ডের সামুদ্রিক উষ্ণতা তাকে পেতেই হবে। মাথা নিচু করে সে সিটিহল অ্যালির নোংরা বাঁচিয়ে দ্রুতপায়ে হাঁটতে লাগল, তারপর একসময় মিলিয়ে গেল গ্যাসবাতির আধো আলোয় ঢেকে রাখা ক্রাম্যার্স স্ট্রীটের ধোঁয়াশার ভিতর।
     আমাদের গল্প এইখানে, সিটি হল অ্যালিতে বব উইলিসের অপসৃয়মান চেহারার প্রেক্ষাপটেই সমাপ্ত হচ্ছে তবে শেষকথা হিসেবে একটা তুচ্ছ ব্যাপার বলা যেতেই পারে যেটা আমাদের গল্পের নায়ক এখনো জানেনা। সেটা হল, যে ওভারকোট সে এইমাত্র গায়ে চড়িয়েছে তার ডানপকেটে একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো ও পেন্সিল রয়েছে। যাতে লেখা আছে, ‘আমার মৃত্যুর পর ওভারকোটখানি যেন মিঃ বব উইলিসকে দিয়ে দেওয়া হয়, মাংস ও মদের দাম বাবদ, ধন্যবাদ।’

বব উইলিস ও একটি কালো কোটের গল্প- পর্ব ৫

সিঁড়ি দিয়ে প্রায় নিঃশব্দে উঠে যাচ্ছিল বব। একতলায় টি টেবিলের সামনে মিসেস হিগিন্‌স এখনো বসে আছেন। টেবিলের উপর চা ও রুটির টুকরো রাখা। ওঁর প্রিয় বেড়ালটি ওঁর কোলের উপর শুয়ে ঝিমোচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে উনি নির্লিপ্তভাবে সোয়েটারের ঘরের মাপ পরখ করছিলেন তবুও কাঠের সিঁড়ির হতাশ ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তাঁর কান এড়াল না। এর মানে হচ্ছে বব উইলিস বিমর্ষ।
—‘সব কিছু ঠিক আছে তো বব? আমি কিছু সাহায্য করতে পারি?’
—‘ধন্যবাদ, মিসেস হিগিন্‌স, আশা করব কাল সকালের আগে আপনার দরকার পড়বে না।’
‘দেখো বব’, মিসেস হিগিন্‌স হাতের কাজ থামালেন, ‘আমি চাই না তুমি কোনো ঝামেলায় জড়াও। আমার মনে হয় বুড়োটাকে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় বিদায় করাই ভালো।’
বব মাথা নীচু করে বলল, ‘আমি অবশ্যই চেষ্টা করব। আশা করছি কাল সকালে—’
—‘দেখ আমাকে পাদ্রীসাহেব বলেছেন, এরা ভীষণ অকৃতজ্ঞ হয়। তাছাড়া কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে যে নিগাররা নাকি বলশেভিকদের দেখাদেখি গোলমাল করার চেষ্টা করছে। শুনছি সরকার থেকে প্রচুর ধরপাকড় আরম্ভ হয়েছে। কাগজে কি লিখেছে শোনো, ‘আমেরিকা আমেরিকানদের জন্য’।’
—‘আমি বিস্মিত হলাম মিসেস হিগিন্‌স, তবে এ লোকটা নেহাতই গোবেচারা।’
‘তাই যেন হয় বব, তবে আমার কথাটা মনে রেখো’, মিসেস হিগিন্‌স উঠে দাঁড়ালেন, ‘শুভরাত্রি বব।’
—‘শুভরাত্রি মিসেস হিগিন্‌স।’
বব বিষন্ন মনে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে নিজের ঘরের দরজার হাতল ঘোরালো। নিগ্রোটার হুঁশ ফিরেছে কি? মাংসের টুকরোটা কি খেয়েছে ও?
     দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই একরাশ চমক ববের জন্য অপেক্ষা করছিল। এ চমক ক্রিসমাসের উপহার পাওয়ার আনন্দের মতো নয়, বা কয়লাখনির ভিতর পাথর খুঁড়ে হঠাৎ একটুকরো হীরে পাওয়ার উত্তেজনার মতোও নয়, এ অন্যরকম অনুভুতি। শীতের রাতে প্রথম তুষারপাতের পর সকালে ঘুম থেকে উঠেই কোন ঘুঘু পাখিকে জানালার পাশে মরে পড়ে থাকতে দেখার মতো। বব প্রথমে ব্যাপারটা ঠিক অনুধাবন করতে পারেনি। কিন্তু মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা নিস্পন্দিত দেহ, নিস্পলক চোখ, মুখের কষ বেয়ে নামা ফেনা, হাত থেকে ছিটকে পড়া মাংসের টুকরো ববকে প্রায় ঘাড় ধরে বুঝিয়ে দিল যে সে এই মুহূর্তে একটি নিগ্রো মানুষের মৃতদেহের দিকে চেয়ে আছে।
হা ঈশ্বর! বব মৃদু স্বরে ডুকরে উঠল। ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে নিগ্রো বুড়োটার গায়ে পা দিয়ে একটু খোঁচা মারল সে। দেহটা নড়ল না, কোনো সন্দেহ নেই এতক্ষণে বুড়ো স্বর্গে পৌঁছেছে। অবশ্য ওর গায়ের রঙ তো কালো, ওরও কি স্বর্গে যাওয়ার কথা?
     ও হয়তো উঠে এসে মাংসটা খাওয়ার চেষ্টা করেছিল, সিদ্ধান্ত করল বব। বহুদিনের অভুক্ত শরীর আর সইতে পারে নি। হয়তো শেষ মুহূর্তে ঐ মাংসের টুকরোর দিকে চেয়েই ও মারা গেছে। এমনও হতে পারে যে ও ববকে ডাকার চেষ্টা করেছিলো। হয়তো নিচের তলায় মিসেস হিগিন্‌স ওর আর্তনাদ শুনতে পাননি। তাছাড়া শুনতে পেলেও কোনোও লাভ হত কি?
     কিন্তু এবার কি হবে? বব শিউরে উঠল। এই নিগ্রোটার মৃতদেহ নিয়ে কি করবে সে এখন? ভয়ভাবনায় তার কান্ডজ্ঞান লোপ পাচ্ছে। তড়িঘড়ি সে সিঁড়ির উপর থেকে চিৎকার করে মিসেস হিগিন্‌সকে ডাকল। অবশ্য খুব জোরে চেঁচাতে সে সাহস পেল না কারণ সে চাইছিল না অন্য বোর্ডাররা ব্যাপারটা জানুক।
মিসেস হিগিন্‌স রাতপোশাকের উপর একটা ওভারকোট মতন চড়িয়ে হলঘরে বেরিয়ে এলেন।
—‘কি ব্যাপার বব?’
—‘নিগ্রোটা,…মারা গেছে!’
—‘হায় ভগবান! কি ভাবে?’
বব মাথা নাড়ল। মিসেস হিগিন্‌স দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে ববের ঘরে উঁকি দিলেন।
‘ওহ্‌ বব, বব, আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম, আমি তোমাকে সাবধান করেছিলাম’, মিসেস হিগিন্‌স প্রায় কাঁদো কাঁদো। বব কোনো কথা না বলে পকেট থেকে রুমাল বার করল।
‘ধন্যবাদ বব’, রুমালে চোখ মুছে মিসেস হিগিন্‌স ভালো করে নিগ্রো বুড়োটাকে দেখতে লাগলেন। তারপ সন্তপর্ণে কাছে গিয়ে মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে হাত রাখলেন। মারা গেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
—‘কি সর্বনাশ বব। এখন কি হবে?’
কিছুই মাথায় আসছিল না ববের। কি জন্য মারা গেল বুড়োটা? বহুদিন না খাওয়ার জন্য! না কি বেজায় ঠান্ডা ওর বুড়ো হাড় নিতে পারে নি। ধীর পায়ে ক্লান্ত ভাবে বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিল সে। শেরিফকে বা টহলদার পুলিশের অফিসে খবর পাঠানো যেতে পারে। ওরা হয়তো এসে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারে।
—‘আমার তা মনে হয় না বব, লোকজানাজানি হলে সরাইখানার সুনামের কি হবে ভেবে দেখেছ একবারও? যীশুর দিব্যি বব, দোহাই ও কাজ কোরো না।’
হতাশ হয়ে বিছানায় বসে রইল বব। ফায়ারপ্লেসের আগুন এখনো জ্বলছে। ঘর এখন বেশ গরম। যদিও বব সেই উত্তাপ উপভোগ করার মতো অবস্থায় নেই। সে ভাবতে লাগল, এসব কিছুই ঘটেনি, নিছকই একটা স্বপ্ন, হয়তো এখুনি সে জেগে উঠে শুনবে সকালের প্রতরাশের জন্য মিসেস হিগিন্‌স তাকে ডাকাডাকি করছেন।
‘একে তুমি কোথায় পেলে বব?’ মিসেস হিগিন্‌স একটু সামলেছেন নিজেকে। হলুদ আলোয় তাঁর মুখ বিবর্ণ দেখাচ্ছে।
বিমর্ষ কন্ঠে বব উত্তর দিল, ‘সিটিহল অ্যালির ভিতরে। রাস্তায় ধুঁকছিল। আচ্ছা ওর জামাকাপড় পকেট এসব খুঁজে দেখলে হয় না, যদি কিছু নাম ঠিকানা হাল হদিস পাওয়া যায়?’
‘ওহ্‌ বব, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, তুমি এখনো শিশুই রয়ে গেছো। আমি চাই না লোকে ব্যাপারটা জানুক। আজকাল ব্যবসাপাতির অবস্থা তো জানোই, এসব জানতে পারলে শহরে নানারকম গুজব রটবে, তখন…’, মিসেস হিগিন্‌স ফের ফোঁপাতে লাগলেন।
—‘আমার সহানুভূতি, মিসেস হিগিন্‌স।’
মিসেস হিগিন্‌স সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। সামান্য উত্তেজিত। বব লক্ষ্য করল তাঁর হাত কাঁপছে।
‘শোনো, চলো লাশটার কিছু একটা করি। জানাজানি হওয়ার আগেই।’
বব মিসেস হিগিন্‌সের দিকে চাইল। আপাতনিরীহ ভদ্রমহিলা। সাধারণ বেশবাস। সাতেপাঁচে থাকেন না। প্রত্যেক সন্ধ্যায় মিস্টার হিগিন্‌সের বিরক্তিকর পিয়ানোর একমাত্র শ্রোতা। বব কখনো তাঁকে জর্জটাউনের ভবিষ্যৎ নিয়ে মতামত দিতেও শোনেনি। সেই মহিলা তাকে সাংঘাতিক একটি কাজ করার পরামর্শ দিচ্ছেন দেখে বব অবাক না হয়ে পারল না।
—‘তুমি কি কাউকে বলেছ, এই নিগ্রোটার কথা?’
বব ইতস্তত করল।
—‘এক সার্জেন্ট, আর মুদীখানার রবিন্‌স।’
—‘তোমার কান্ডজ্ঞানের তারিফ করতে হয় বাছা। ঈশ্বর কি তোমাকে বুদ্ধি ছাড়া পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন? চারিদিকে কি হচ্ছে তা জানো না?’
বব জানে। গতকালই পোটোম্যাক নদীর ধারে একটা মাছের বোটের ভেতর তিনজন নিগ্রোকে খুন করেছে ওরা। বোটের মালিককেও একই সঙ্গে মেরে নোটিশও লটকেছে।
‘শোনো, আমার কাছে মাংসকাটার বড় ধারালো ছুরি আছে। আমরা ওকে কেটে ছোট ছোট টুকরো করে ফেলতে পারি। তারপর ব্যাগে ভরে কোথাও ফেলে দিতে পারি’, একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে মিসেস হিগিন্‌স ববের দিকে চোখ বড়বড় করে চেয়ে রইলেন। অনুমোদন পাওয়ার অপেক্ষায়।
—‘ওকে টুকরো করবেন?’
—‘ভেবে দেখ বব, কেউ জানতে পারবে না। পুলিশ জিজ্ঞাসা করলে বলবে, শেষবার ওকে তুমি ব্রডওয়ের দিকে যেতে দেখেছ।’
বব ব্যাপারটাতে রাজী হল না। তার ধারণা নিগ্রোটার পিঠের হাড় খুবই শক্ত, সুতরাং ছুরি দিয়ে কাটা যাবে না। চারিদিক রক্তারক্তি হবে।
—‘বব, আমি এসব বরদাস্ত করবো না, এই ঝামেলা তুমি নিয়ে এসেছো, তোমার কি মনে হয় না তোমাকেই ব্যাপারটা সাফ করতে হবে।’
—‘অবশ্যই মিসেস হিগিন্‌স, আমি মেনে নিচ্ছি এ আমার দোষ। নিজেকে নীচ লাগছে। কেন যে আমি আপনাদের বিব্রত করলাম। ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করবেন না। মনে হচ্ছে সমস্ত সৎ ও ভালো কাজ করার যোগ্যতা আমি হারিয়েছি। যেমন মেরীকে ঘোড়ায় চড়া শেখানো।’
মিসেস হিগিন্‌সের মুখ পলকে আরক্ত। বব বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। চুল্লীর আগুন আরো একটু উস্কে দিয়ে সে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। বাইরে অবিশ্রান্ত বরফ পড়ছে। তার বহুদিনের সঙ্গী জানালার পাশের ইউক্যালিপ্টাস গাছের পাতার সবুজ রঙ প্রায় অন্তর্হিত। এক বিরাট ক্রিসমাস ট্রী যেন।
—‘কোনো মতলব বব?’
মিসেস হিগিন্‌সের দিকে ঘুরে দাঁড়াল বব। মহিলা দরজার ধার ঘেঁষে রাগত মুখে তাকিয়ে আছেন। তাঁর সামনেই নিগ্রোটার মৃতদেহ। বব ভাবল, ইস্‌ ও যদি জানতে পারত ও হেভেনে কয়েক টুকরো অবস্থায় যাবে তাহলে এইভাবে মরার ঝুঁকি নিত না। নিগ্রোটার দিকে চেয়ে বব নিচু গলায় বলল,
—‘শুনুন, সার্জেন্ট র‌্যামোস আমাকে একটা পরামর্শ দিয়েছিল, বুড়োটাকে রাস্তার মোড়ের জঞ্জালের উপর ছুঁড়ে ফেলতে।’
‘তবে তাই কর না কেন?’, মিসেস হিগিন্‌স উৎসাহিত হলেন।
—‘দেখুন, আমার মনে হয় ওর পরিবার ইত্যাদির খোঁজ একবার করা উচিত। তাহলে বিবেকের কাছে —’
—‘তোমাকে পরিষ্কার বলছি বব। জর্জটাউনে যারা ছুটি কাটাতে আসে তারা আমার সরাইখানা ভীষণ পছন্দ করে কারণ এখানে গোলমাল হয় না, এখন যদি এসব…’
মিসেস হিগিন্‌সকে হাত তুলে থামিয়ে দিল বব। সে জানে ওঁর আপত্তি যুক্তিসঙ্গত। আশ্বস্ত করে সে মিসেস হিগিন্‌সকে চিন্তামুক্ত হওয়ার অনুরোধ জানাল, কেননা সকাল হওয়ার আগেই সে বুড়োকে জঞ্জালের স্তূপে ছুঁড়ে ফেলে আসবে।

Thursday, 15 December 2011

বব উইলিস ও একটি কালো কোটের গল্প- পর্ব ৪

     রাস্তার পেভমেন্ট ধরে চলতে বব ভীষণ ভালোবাসে, কারণ জর্জটাউনের কোথায় কী হচ্ছে সে সব জানার সেরা উপায় হল ঐটে। এতে কি হয়, হাঁটার একঘেয়েমিটা কিছুটা কাটে। যেমন গত বিষ্যুদবার সে জেনেছিল শহরের নতুন রেস্তোঁরার উদ্বোধনের কথা এবং মেয়েদের নেলপলিশের নতুন ফ্যাশন। শহরের সবচেয়ে ধনী বাউন্ডুলে কিংবা দাবার কোনো নতুন চাল। মধ্যবয়সীদের পেছু পেছু হাঁটলে তাদের বিরক্তিকর স্ত্রীদের বিচিত্র খেয়ালের কথাও জানা যায়। লাঠি হাতে বুড়োগুলো সেরকম আকর্ষণীয় নয় কিন্তু ছেলে ছোকরাগুলো বেশ মজাদার। ওদের আলোচনা থেকেই বব জেনেছে যে জর্জটাউন পাবলিক স্কুলে এখনও নিগ্রো ছেলেমেয়েদের জল খাবার জায়গা আলাদা।
     কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, শীতের রাতে যখন চতুর্দিকে বরফ পড়ছে, অল্প কুয়াশায় দূরের কিছু দেখা যায় না, তখন লোকজন সব নিজের সাথেই একমাত্র কথা বলে। শীতকালেই বোধহয় সবাই তাদের নিজেদের স্বাস্থ্য, বাড়ীর মর্টগেজ, ছেলেমেয়েদের স্কুলের অনুষ্ঠান এবং নিজেদের জীবনের কথা ভাবে। মাথা নিচু করে ঘাড় গুঁজে যতটা সম্ভব ঠান্ডার আঁচড়কামড় বাঁচিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মানুষ নিজের কাছেই অজান্তে ফিরে আসে বারংবার। সুতরাং বব এমন একজনকেও পেল না যে তার ক্ষণিক আগেকার মহৎ কীর্তির কথা জানতে উৎসুক।
     অবশেষে রবিন্‌সের মুদিখানার কাছাকাছি পৌঁছে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। দরজা বন্ধ যদিও ভিতরে আলো জ্বলছে। চেস্টারের পাবে না হয় পরে যাওয়া যাবে, আপাতত রবিন্‌সকে একটু বাজিয়ে দেখা যাক, যদি কিছু সাহায্য পাওয়া যায়। রবিন্‌স কি সওদায় ব্যস্ত এখন? কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে একটি অল্পবয়সী মুখ দরজার ঝাপসা কাচের ওধারে উঁকি মারল।
—‘খোলো হে, যীশুর দিব্যি।’
অল্পবয়সী মুখের ছোকরাটি রবিন্‌সের ছেলে। ক্ষণিক ইতস্তত করে সে দরজা খুলে দিল। ভেতরটা বেশ গরম।
—‘আমি ভেবেছিলাম রবিন্‌সের সাথে দেখা করবো।’
‘কি চাই তোমার, বব’, উত্তর এল ঘরের কোণ থেকে। বড়সড় পশুচামড়ার কম্বল জড়িয়ে বেঁটে খাটো রবিনস কৌচের উপর বসে আছে। গ্যাসবাতির আলোয় ওর মুখটা পাঁশুটে দেখাচ্ছে। তার হাতে সকালের খবরের কাগজ, মুখে পাইপ। ঘরের ভেতর নানারকম মালমশলার ক্রেট। একপাশে উঁচু টেবিলের উপর বিভিন্ন প্রাচ্যদেশীয় মশলার প্যাঁটরা।
একটু কেশে গলা সাফ করে বব বলল, ‘একটু উপকার যদি কর রবিন্‌স।’
—‘তোমার কি মনে হয় না, আবহাওয়াটা ঠিক উপকার করার উপযুক্ত নয়?’
—‘তা বটে, তবে আমার শুধু একটু রুটি দরকার ছিল।’
—‘বেশ তো, এ আর এমন কি কথা। পয়সা ফেল, সানন্দে রাজী থাকব।’
বব একথায় একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলল, যেটা রবিন্‌সের নজর এড়াল না।
‘দেখো বব, এমনিতে আমি খুব খারাপ লোক কিন্তু আমার ঠাকুর্দার একটি শিক্ষা আমি পেয়েছি, সেটা হল ঘরের বউ এবং দোকানের মাল কখনো ধারে বেচতে নেই’, রবিন্‌স বিশ্রী ভাবে হেসে উঠল। সারা শরীর জুড়ে হাসছে। বব লক্ষ্য করল হাসির দমকে ওর মুখ লাল হয়ে উঠেছে।
বব স্থির করল, এই জাতীয় মানুষেরা মানবতার শত্রু এবং এদের কাছে মানুষের মহৎ প্রচেষ্টার কোনো দাম নেই। নেহাত মাইনের টাকা পয়সা সে উড়িয়ে দিয়েছে, না হলে রবিন্‌সের সাথে ফালতু বাক্যালাপ করার লোকই সে নয়। কুড়ি ডলার মাত্র তার সম্বল, হ্যামন্ড যাওয়ার ট্রেনভাড়া, কিছুতেই সে সেটাকে খরচ করবে না। সে ভাবল বুড়ো নিগ্রোটার স্বার্থে আরেকবার অনুনয় করে দেখবে।
—‘আমি অবাক হচ্ছি বব। হিগিন্‌স কি তোমার খেয়াল রাখছে না। নাকি রোজকারপাতি ছেড়ে দিলে?’
বব বিরক্ত হল। কোটের কলার থেকে বরফকুচি পরিষ্কার করতে করতে সে বলেই ফেলল আসল কারণ। এটাও জানাতে ভুলল না যে ঈশ্বর কালো মানুষদেরও নিজের সন্তান ভাবেন এবং পরের মাসে মাইনে পেলে সে প্রথমে রবিন্‌সের ধারই শোধ করবে।
—‘শোনো, তুমি ভুল দিনে এসেছো। সাধারনত রবিবার যখন গীর্জায় যাই তখনই একমাত্র আমি ধর্মপ্রাণ খ্রীষ্টান, বাদবাকি সময় আমি শয়তানের পরামর্শ অনুযায়ী চলি। যেমন এখন সে আমায় বলছে যে, তোমার উচিত আমার কুকুরটার জন্য কিছু খাবার কিনে দেওয়া কারণ, ওর গায়ের রঙও কালো।’
দড়াম করে দরজাটা টেনে বেরিয়ে এলো বব। আসার সময় সে শুনতে পেল, রবিন্‌স তুমুল হাসতে হাসতে বলছে, ‘নিগ্রোটাকে ধোলাই দেওয়ার দরকার পড়লে আমাকে বলো, বব। একাই আনন্দটা উপভোগ কোরো না যেন।’
নিপাত যাও! তোমার জন্য নরকও যথেষ্ট নয়। বব ভীষণ রেগেমেগে হন্‌হন করে চলতে লাগল। বুড়ো বেনসন জর্জটাউনের দোকানীদের যে মানুষ বলে গন্য করে না তার যথেষ্ট কারণ আছে তাহলে।
ক্রামার্স স্ট্রীটের শেষে আরো দু’টো বেকারী আছে। ববের মনে হল সব দোকানীই রবিন্‌সের মতো হৃদয়হীন হবে না নিশ্চয়।
     কিন্তু ববের কপাল মন্দ। দু’জায়গাতেই তাকে গলাধাক্কা খেল সে, এমনকি কিছু লোক বিদ্রুপ করতেও ছাড়ল না। কেউ কেউ গীর্জার কাজকর্ম সম্পর্কে তো সন্দেহই প্রকাশ করে ফেলল। হতাশ হয় বব যখন ভাবছে এরপর কোথায় যাওয়া যায়, ঠিক তখনই তার মনে হল ঈশ্বর বোধহয় ওই জমানো ডলারগুলোর ওপর বিরক্ত। ঠিক আছে, উপরওয়ালার ইচ্ছানুযায়ীই সে কাজ করবে। দাঁতে দাঁত চিপে সে সংকল্প করলো নিগ্রো বুড়োটাকে সে সুস্থ করে তুলবে, দরকারে তার নিজের জমানো টাকা খরচ করেই।
     রাগের চোটে কিছুক্ষণ এলোমেলো রাস্তায় ঘোরার পর অবশেষে কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সে মাথা নীচু করে রওনা দিল বাড়ির দিকে।

বব উইলিস ও একটি কালো কোটের গল্প- পর্ব ৩

     বব উইলিসের দোতলার ঘরে যদি আপনি কোনকালে পা রাখেন তো প্রথমেই আপনার চোখে পড়বে একটা পুরু গদিওয়ালা বিছানা, সেই সঙ্গে টেবিলের উপর একটা কাঁচের জারের মধ্যে গোল্ডফিশ, দেওয়ালে ওয়ালরথ পাইপ রেঞ্চ কোম্পানির ক্যালেন্ডার। এছাড়া আশেপাশে চোখ বুলোলে দেখতে পাবেন একটা সস্তা কাঠের আলমারি এবং ববের সাধের ইজিচেয়ার যার উপর একটা ময়লা তোয়ালে রাখা। এই সব দেখে যখন আপনি ভাবছেন যে বব মানুষটি ভীষণ সাদাসিধে ঠিক তখনই আপনার চোখে পড়বে ঘরের এককোনায় রাখা বইয়ের র‌্যাক যেটি দর্শনের বইয়ে ঠাসা এবং তৎক্ষনাৎ আপনি বব সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত বদলাবেন। কিন্তু আসল ব্যাপার হল এসব বই সে কোনোকালেই পড়ে না, ওগুলো নিতান্তই তার পৈতৃক সম্পত্তি।
     বব শুধু বিছানায় শুয়ে কোলিয়ারীর ইউনিয়নের সাপ্তাহিক মুখপত্র পড়তে ভালবাসে কেননা সে এটা প্রায় ছোটোবেলা থেকেই পড়ে আসছে। চুপ করে বিছানায় শুয়ে সিলিং এর দিকে চেয়ে বহুদিন আগেকার ‘দি লেবার উইকলি’র পাতায় চুল রঙ্গীন করার বিজ্ঞাপন, কিংবা ব্যালেরিনাদের ছবির কথা ভাবা তার বহুদিনের অভ্যাস। তার মনে পড়ে গ্যারি শেফার্ডের জাঁকালো জোক্‌সগুলোর কথাও, কিন্তু শীতকালে সেসবে সে বিরক্ত বোধ করে। মাঝে মাঝে অলস ভাবে বিছানায় শুয়ে ববের নিজেকে মনে হয় কারাগারের বন্দী যেখানে তার সঙ্গী বলতে কেবল তার হাতঘড়ি এবং তার বিছানা। তার বহুদিনকার পুরনো বিছানা যেখানে এখন নিগ্রো বুড়োটা কোট জুতো সমেত শুয়ে আছে।
     ঘরের আলোয় বুড়োকে ভালো করে লক্ষ্য করল বব। কোলকুঁজো চেহারা। মুখখানা হাঁ করে হাপরের মতো শ্বাস নিচ্ছে। সাদা দাড়ির সাথে বরফকুচি মিশে আছে। ববের মনে হল থিয়েটারে ওকে বুড়ো চাকরের ভূমিকায় ভালো মানাবে।
‘এই তবে ব্যাপার, তা আমাকে খুলে বলতে পারো সব।’ বব ফায়ারপ্লেসের চুল্লীতে কাঠকয়লা গুঁজতে লাগল। ঘর আরো একটু গরম হলে যদি বুড়োর হুঁশ ফেরে।
বৃদ্ধ লোকটি অবশ্য একইরকম ভাবে শুয়ে রইল। পা দু’টো মুড়ে একটা হাত মাথার পেছনে দিয়ে একপাশে কাত হয়ে। চোখ দু’টো বোজা। ওর সারা শরীর এমনভাবে কোটে ঢাকা যে দেখে মনে হচ্ছে একতাল কালো কাপড় যেন কেউ দলা পাকিয়ে ফেলে রেখেছে। ববের একবার মনে হল কোনো ডাক্তারকে ডেকে আনার কথা। তার উপরতলাতেই তো একজন আছে, সবসময় সাদা পোশাক পরা ফিটফাট ছোকরা ডাক্তার। কিন্তু ফি দেওয়ার ক্ষমতা ববের নেই, তাছাড়া কালো মানুষ দেখে সে ছোকরা নাক সিঁটকে চলেও যেতে পারে।
—‘ওর দরকার পথ্য, আর সেটা আমিই জোগাড় করতে পারব। বলা যায় না কিছুটা খাবার খেলেই হয়তো ও সুস্থ বোধ করবে।’
জানালার সার্সিগুলো ভালো করে এঁটে দিল বব। নিজের কম্বলটা ওর কোটের ওপর চাপিয়ে দিল যাতে বুড়ো একটু আরাম পায়।
—‘ও নিশ্চয় আমাকে দেবদূত ভাবছে। ভাববে নাই বা কেন? এখনো অবধি যে ও বেঁচে আছে সে তো আমারই জন্য। কোনো সন্দেহ নেই, ঈশ্বর ব্যাপারটা লক্ষ্য করছেন।’
     চুল্লীতে আরও কিছু শুকনো কাঠ গুঁজে দিল বব। যতটুকু কাঠকয়লা সে সারা সপ্তাহের জন্য বাঁচাতে পেরেছিল তার প্রায় সবটুকুই। আরো উত্তাপ চাই। তাহলে বুড়োটা হয়তো গা হাত পায় জোর ফিরে পাবে। হয়তো উঠে বসে সে ববকে তার প্রাণ বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ জানাবে এবং বলবে আসলে সে জর্জটাউনে এসেছিল হার্লেম শহরের খবর নিয়ে। হয়তো এও বলবে যে তার মাছের স্যুপ ভালো লাগে না, সুতরাং বব যেন অন্য ব্যবস্থা করে। ফায়ার প্লেসের ধারে তার প্রিয় আরামকেদারাটা টেনে নিয়ে আগুনের উত্তাপে হাত পা সেঁকতে সেঁকতে বব কল্পনা করছিল, বুড়ো কৃতজ্ঞতা জড়ানো মুখে তার হাতে চুমু খাচ্ছে।
     এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ হল এবং বব এমনভাবে লাফিয়ে উঠল যেন সে এরই প্রত্যাশা করছিল।
—‘আসুন মিসেস হিগিন্‌স, আমি আপনার আসার অপেক্ষাতেই ছিলাম। মিঃ হিগিন্‌স রেওয়াজে ব্যস্ত বুঝি!’
—‘ওহ্‌, বব! সবই তো বোঝ। আচ্ছা, দেখো কিছুটা শুকনো মাংসই কেবল আমি তোমাকে দিতে পারি। আর এই কিছুটা মদ।’
—‘অশেষ ধন্যবাদ, আশা করব এতটাই আমাদের অতিথির জন্য যথেষ্ট।’
মিসেস হিগিন্‌স টেবিলের উপর কাঠের রেকাবিটা রেখে একটু ইতঃস্তত করে বললেন, ‘বড়দিনের ছুটিতে আশা করি তুমি মেরীকে ঘোড়ায় চড়া শেখাতে পারবে?’
—‘সানন্দে। একাজের জন্য মিঃ হিগিন্‌সের খামারবাড়িটাই আমি উপযুক্ত মনে করি।’
মিসেস হিগিন্‌সের মুখ একটু রক্তাভ হল। অস্বস্তির হাসি হেসে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
নিগ্রো বুড়োটা চোখ মেলে তাকিয়েছে। এখন আর ঘোলাটে দৃষ্টি নয়। কিছু যেন খুঁজছে। বব বিছানার পাশে গিয়ে বুড়োর মুখের উপর ঝুঁকে পড়ল।
—‘তুমি চাইলেই মাংসের টুকরোটা খেতে পার। কিছুটা মদও আছে।’
বুড়ো বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। ববকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে কি?
—‘দেখ নেহাত আমাকে চেস্টারের পাবে যেতেই হবে সে কারণে এক্ষুনি তোমার খিদমত করতে পারছি না। তুমি কিছু বলতে চাও কি? অন্তত নামটুকুও বলতে তো পার।’
বুড়ো চুপ করে রইল। ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁক করা।
—‘বেশ যেমন তোমার মর্জি। দেখ, আমি সাধারণত বেশী মদ খাই না, তবে আজকের কথা বলতে পারছি না। শোনো, নিচের একতলায় ওরা বসে আছে, কিছু প্রয়োজন পড়লে বেল বাজিয়ে বুড়ীটাকে ডেকো। ওর নাম মিসেস হিগিন্‌স তবে তুমি উইলেলা বলে স্বচ্ছন্দে ডাকতে পার।’
বাইরে এখনো বরফ পড়া থামেনি। সেদিকে চেয়ে হতাশ হয়ে বব তার হাতের দস্তানাটা আগুনের তাপে সেঁকতে লাগল। মন অন্যমনস্ক। শীতকালে এইরকম বরফ পড়া সন্ধ্যায় সে সাধারণত একতলায় বসে মিসেস হিগিন্‌সের সাথে নানান টুকিটাকি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। জর্জটাউনে সবজির আমদানী, পিয়ানোর কনসার্ট, ধর্মালোচনা বা ঈশ্বর কত করুণাময় ইত্যাদি। আজ সে বেশ প্রশান্তি অনুভব করছিল কেননা এরপর থেকে কেউ হয়তো রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় তাকে দেখিয়ে বলবে, ঐ যে বব উইলিস, একটা নিগ্রো বুড়োকে যে প্রাণে বাঁচিয়েছে। হয়তো শেরিফ তাকে একটা প্রশংসাপত্র লিখে দেবেন, ‘বব উইলিস…অমুক তারিখে অমুক ইত্যাদি’। নিজের মধ্যে মহতী গুণ আবিষ্কার করে বব একটু অবাক না হয়ে পারল না। সে তাহলে লোক খারাপ নয়।
     একটা শিস দিয়ে উঠল বব। নিজের প্রতি তার ভীষণ গর্ব হচ্ছে। দ্রুত গরম জামাকাপড় পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এল বব। তার দরকার একটু খোশগল্প এবং দুপাত্তর পান। একতলায় সোফায় বসে মিসেস হিগিন্‌স তাঁর বোনঝিকে সোয়েটার বোনা শেখাচ্ছিলেন। সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেয়ে দেখলেন, বব উইলিস নেমে আসছে। এক, দুই…এক, দুই, বেশ ছন্দ করে ক্যাঁচক্যাঁচিয়ে উঠছে কাঠের সিঁড়ি। মিসেস হিগিন্‌স ও আওয়াজ বিলক্ষণ চেনেন। ওর মানে বব উইলিস এখন ভরপুর আনন্দে মশগুল।

বব উইলিস ও একটি কালো কোটের গল্প- পর্ব ২

     ক্র্যামার্স স্ট্রীটের আশপাশ বেশ ঘিঞ্জি। কোলিয়ারীতে যারা কাজ করে তাদের অধিকাংশেরই এখানে বসবাস। বাড়িঘর সব গা ঘেঁষাঘেঁষি। যাদের একটু বেশি পয়সাকড়ি আছে, তাদের বাড়ির সামনে ছোট্ট বাগান। কারও বাড়ির দেওয়ালে ‘বেবিরুথ’ কোম্পানির চকোলেটের বিজ্ঞাপন সাঁটা। বেশ কিছু কালো চামড়ার লোকও এখানে থাকে, যাদের বাড়ির সামনে গেলে স্নোফ্লেক পুডিংএর গন্ধ পাওয়া যায়। এরা ভীষণ নোংরা এবং ঈশ্বরের অসীম দয়া যে এরা কখনো চেস্টারের পাবে ঢোকে না। যে কোনদিন সকাল আটটার সময় কারখানার ভোঁ বাজলে, সার সার জামা জুতো পরে কালো মানুষগুলো মাথা নিচু করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। বব তার দোতলার জানালা থেকে প্রায়শই দেখেছে ওরা পারতপক্ষে কখনো একা একা হাঁটে না। এদের বেশিরভাগই ভবঘুরের দল। কাজ পাওয়ার আশায় দলে দলে এসেছিল এককালে। পুরনো গীর্জার কাছাকাছি সরাই গুলোতে এখনও এরা গাদাগাদি করে থাকে।
     দরজা খুলে রাস্তায় বেরোতেই কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপ্টা লাগলো ববের চোখেমুখে। রাস্তায় প্রায় ছ’ইঞ্চি মোটা বরফের স্তর। সারাদেহ ঢাকা সত্ত্বেও বব কেঁপে কেঁপে উঠছিল।
—‘শুভসন্ধ্যা বব, ওঃ কি ঠান্ডাটাই না পড়েছে!’
বিলি জো, সবাই ডাকে লড়াকু জো বলে। দীর্ঘ চেহারা, মজবুত গড়ন, বাপের দর্জির দোকানে আগে কাজ করত। দু’বছর হল কোলিয়ারীতে ঢুকেছে। বব ওকে বিশেষ পছন্দ করে না কারণ বিলি জ্যাজ মিউজিক নিয়ে হুজুগেপনা ভালোবাসে এবং প্রতি রবিবার গীর্জায় গিয়ে সারাক্ষণ মেয়েদের সাথে ঠাট্টাতামাশা চালায়।
—‘শুভসন্ধ্যা জো! চললে কোথায়?’
—‘মিস আইভি রাইট আমাকে ওর বাসায় নেমন্তন্ন করেছে! হেঃ হেঃ।’
বব লক্ষ্য করল, জো এর বাঁহাতে একটা বড়সড় কাপড় ঢাকা বেতের ঝুড়ি। বোঝাই যাচ্ছে সন্ধ্যা উদ্‌যাপনের জন্য সে বেশ তৈরী হয়েই যাচ্ছে।
—‘আচ্ছা বব্‌, আমার তাড়া আছে, বুঝতেই তো পারছ। হেঃ হেঃ’
চুলোয় যাও। বব বিরক্ত হয়ে পা চালাল। এইসব লোকেদের থেকে সে সর্বদা দূরে থাকার চেষ্টা করে। পথচলতি উটকো লোকেদের এড়াবার জন্য সে গলিঘুঁজি দিয়ে চলতে লাগল।
     সিটিহল অ্যালির ভেতরে ঢুকে সে খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করল, কারণ রাস্তাটা অপেক্ষাকৃত নির্জন। সরু গলিটার দু’ধারে বেশ উঁচু বাড়ি থাকার জন্য বরফও একটু কম। একটু অন্ধকারও বটে। মাঝে মাঝে ফায়ার এস্কেপের সিঁড়ির তলার জানালার ফোকর থেকে বাড়ির ভেতরের আলো এসে পড়েছে। বেশ গা ছমচমে। চলতে চলতে বব জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে বাড়ির ভেতর উঁকি মারতে লাগল।
গলির শেষপ্রান্তে পৌঁছে বব দেখল, যেখানে পুরোনো বাতিল টায়ারগুলো একপাশে জড়ো করে রাখা, তার পাশে একটা অন্ধকার মতোন যেন দলা পাকিয়ে ঘুপচি হয়ে আছে। কৌতূহলী হয়ে কাছে যেতেই বব দেখল কেউ একজন হাত পা জড়োসড়ো করে হাঁটু মুড়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। আপাদমস্তক একখানা কালো কোটে ঢাকা। তার উপর বরফকুচি ছড়িয়ে রয়েছে। দূরের বড়রাস্তা থেকে যেটুকু আলো আসছে তাতে আর কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটা মৃতদেহ নয়, বব স্থির করল, কারণ মাঝে মাঝে গোঙানির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
একটা শিস দিল বব, ‘এইও, কে তুমি?’
কোনো উত্তর নেই।
বব এবার একটু ঠেলা দিল, ‘এইও, শুনতে পাচ্ছ?’
—‘দূর হ! শয়তান।’
বাব্বা, মেজাজ আছে বটে। বব একটু আমোদ পেয়ে ধীরে ধীরে ওর মুখের ওপর থেকে কাপড়টা সরাতেই দেখতে পেল, মাথায় সাদা চুল এক বুড়ো, মুখে অসংখ্য বলিরেখা, ঠিক যেমনটা তাদের শিফ্‌ট অপারেটরের মুখে রয়েছে, ঘোলাটে দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কালো মুখে চোখ দু’টো কোটরে ঢোকা, সাদাটে দাড়ি, হঠাৎ দেখলে মনে হয় কতদিন না খেতে পেয়ে রয়েছে। মুখের গড়নে অনেকটা ককেশীয় ছাপ স্পষ্ট।
—‘এমন শীতের সন্ধে কাটানোর উপযুক্ত স্থানই বটে, কি বল?’
বুড়ো কোনো জবাব দিল না, আপনমনে চোখ বুজে কি সব বিড়বিড় করছে।
একটু উসখুশ করল বব। লোকটা এমনভাবে এখানে বসে আছে কেন? এখানে শীতে জমে যেতে কতক্ষণ। অবশ্য ওর গায়ের কোটটা যদিও বেশ মোটা। পা দিয়ে কোটটা একটু উঁচু করে তুলে বুড়োর পায়ের কাছটা দেখল বব। যুদ্ধের পর সেনারা যেসব ছেঁড়া বুটজুতো বিক্রি করেছিল সেইরকমই একজোড়া বুটজুতো। বুড়ো ফের নড়ে উঠে একটু গোঙাল।
—‘এর থেকে নিজের ঘরে বসে আফিম খেলেই তো পারো। থাকো কোথায়?’
বুড়ো একথারও কোনো জবাব দিল না। শুধু তাই নয়, পরবর্তী পাঁচমিনিট ধরে ববের কোনো প্রশ্নেরই কোনো উত্তর দিল না। বাধ্য হয়ে বব স্থির করল বুড়ো হয়তো কানে খাটো অথবা উন্মাদ নয়তো সেইসব বেয়াক্কেলে লোকগুলোর একটা যাদের একমাত্র কাজ হল ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে পুরনো চিঠিপত্র পড়া।
বিরক্ত হয়ে বব স্থির করল এই ব্যাপারটা খোদ ঈশ্বরের উপরেই ছেড়ে দেওয়া যাক। পাদ্রী সাহেব যেমন বলেন, মুশকিলে পড়লে বাইবেলে বর্ণিত ওই ভদ্রলোকটিই তোমাকে পথ দেখাবেন।
এমন সময় গলিতে আরও একটি মানুষের আবির্ভাব ঘটলো। যার লাঠি এবং টুপি দেখে ববের চিনতে কোনো অসুবিধা হলো না। সার্জেন্ট র‌্যামোস। হাতে অর্দ্ধেক শেষ হওয়া বোতল। ববকে দেখে সে ধীর পায়ে এগিয়ে এল।
—‘আরে, আমাদের বব উইলিস যে। কী ব্যাপার বব, এই মারাত্মক শীতে সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়েছ নাকি?’
বব কোনো কথা না বলে ইশারায় বুড়োকে দেখাল।
সার্জেন্ট র‌্যামোস একটু ঝুঁকে পড়ে বুড়োটাকে দেখল। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘না হে, এ সেই লুটেরা বেঞ্জামিন রাইডার নয়। তুমি যদি ইনামের কথা ভেবে থাক, তাহলে বলতেই হচ্ছে তোমার কপাল মন্দ।’
—‘লোকটা কে?’
—‘কি করে বলব হে, আগে দেখিনি বলেই তো মনে হচ্ছে। হয়তো কাজের সন্ধানে এসেছিলো। ভবঘুরেও হতে পারে, তবে কোটটা খাসা বাগিয়েছে।’
—‘তোমার কি ওকে থানায় নিয়ে যাওয়া উচিত নয়? এখানে থাকলে তো শীতে মারা পড়বে।’
সার্জেন্ট র‌্যামোস বেশ বিরক্ত হল একথা শুনে। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘শোনো বব, তোমাকে আগে বলিনি, আমার এখন ডিউটি দেওয়ার কথাই নয়। নেহাত চেস্টারের পাবে গলা ভেজাতে এসেছিলাম বলেই না। আর তাছাড়া আমার বউ কত ভালো লেটুস পাতার স্যুপ বানায় তা জান। সেসব ছেড়ে এখন থানায়...তা, তোমার এত দরদ যখন নিজের সাথে নিয়ে গেলেই তো পারো। নতুবা শেরিফকে খবর দাও।’
বব কোনো কথা না বলে বুড়োটার দিকে চেয়ে রইল। রাস্তার ধারের গ্যাসবাতি গুলো জ্বলে উঠেছে। সেই আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে লোকটা ঠান্ডায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। ওর দিকে চেয়ে ববের করুণা হল। হয়তো ওর কেউ নেই, হয়তো ও আজ ডিনার টেবিলে বসে রুটিটা নোনতা বলেছিল, তাই হয়তো ওর বৌ ওকে বার করে দিয়েছে। হয়তো ও জর্জটাউনের রেলইয়ার্ডে কোনো কাজ চাইতে এসেছিলো, ওর বেঁটে বেঁটে হাত পা দেখে ওরা তাড়িয়ে দিয়েছে। ববের মনে হল এই সেই সময় যখন ঈশ্বর পরীক্ষা নেন মানুষের মানবিক বোধের। ঝট করে বব স্থির করল লোকটিকে সে বাড়ি নিয়ে যাবে।
পরিকল্পনাটা র‌্যামোসকে খুলে বলতেই সে একচোট হেসে বলল, ‘পাদ্রী সাহেব তোমার মাথা খেয়েছেন দেখছি। শোনো, লোকটা এমনিই মারা যাবে, রেডিওর খবর শুনেছ, টানা দু’দিন এরকম তুষারপাত চলবে। বুড়োর মরার ইচ্ছে হয়েছে, বুঝলে। এক কাজ কর, ওকে ওই যে বড় জঞ্জালের ঢিবিটা দেখছ, ওখানেই ছুঁড়ে ফেলে দাও না কেন। ব্যাপারটা কাল সকালের সাফাইওয়ালাদের ওপর দিয়েই যাবে।’
প্রস্তাবটা ববের মনঃপুত হল না। এমনও তো হতে পারে যে বুড়োটা হয়তো পথ হারিয়েছে, হয়তো ওর অন্য কোথাও যাওয়ার কথা। কোনো বাড়ি বা সরাইতে জায়গা না পেয়ে শেষে এখানে এসে বসে রয়েছে। ওর দরকার পর্যাপ্ত খাবার এবং ঘুম।
—‘বেশ নিয়ে যেতে পারো, তবে ফ্যাসাদে পড়তে পারো কিন্তু।’
সে যাই হোক, বব তবু একবার চেষ্টা করে দেখবে বৈকি। র‌্যামোসকে সে অনুরোধ করল তাকে একটু সাহায্য করার জন্য।
—‘মন্দ বলনি। মাঝে মাঝে আইনরক্ষক হিসেবে আমারও যে কিছু করনীয় আছে তা মনে করা ভাল। তাছাড়া একটু গা গরমও হবে।’
দু’জনে মিলে বুড়োর হাত পা ধরে তুলে নিয়ে চলতে লাগল। গলিটা একেই বেশ সরু, তাছাড়া যত্রতত্র টিন ক্যান আর জঞ্জাল আবর্জনায় ভর্তি, তাই ওদের চলতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল।
—‘তোমার কি মনে হয় বব? আমার কথাও ওপরওয়ালার ভাবা উচিত, নয় কি?’
—‘কেন বলতো?’
‘এই যে, তোমার মহৎ কাজে তোমাকে সাহায্য করছি, প্রতিদানে ঈশ্বরের আমাকেও কিছু দেওয়া উচিত। যেমন ধর ক্রিসমাস গিফ্‌ট হিসেবে একটা পুরোনো কনিয়াকের বোতল’, র‌্যামোস হাঁফাতে লাগল।
—‘তোমার রুচি আছে বটে, ওপরমহলে মেলামেশা কর নাকি?’
র‌্যামোস ঘাড় নাড়ল। সে বড়লোকদের দু’চক্ষে দেখতে পারে না, বিশেষ করে যারা র‌্যাকুন কোট পরে এবং দর্জির কাছে ট্রাউজারের নিচের মাপ চব্বিশ ইঞ্চি দেয়। তার দৃঢ় বিশ্বাস ভলস্টেড আইন চালু করার পিছনে এই লোকগুলোরই হাত রয়েছে। এদের জন্যই সিগারেটের প্যাকেট তাকে দশ সেন্ট দিয়ে কিনতে হয় এবং সুবিধা পেলে এই ধরনের বখাটেদের সে মজা দেখাবে।
     সরাইখানার সামনে পৌঁছে বব শুনতে পেল হিগিন্‌সের পিয়ানোর আওয়াজ। তার মানে মজলিশ এখনো শেষ হয়নি। সে র‌্যামোসকে ধন্যবাদ জানাল এবং এটাও জানাতে ভুলল না যে বব তার হয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবে। লোকজনের গলার আওয়াজ পেয়ে হিগিন্‌স কৌতূহলী হয়ে পিয়ানো ছেড়ে উঠে এলো।
—‘বাহ্‌, বেশ তো বব। শোনো, আমার সরাইখানা ট্রেভরের শুয়োর খোঁয়াড় পাওনি।’
—‘একটা রাতের ব্যাপার হিগিন্‌স, ও আমার ঘরেই না হয় থাকবে, শীতে কষ্ট পাচ্ছিল, তাই তোমার এখানে নিয়ে এলাম। কিছু খাবার পেতে পারি মিসেস হিগিন্‌স? বলতেই হচ্ছে, আপনার ক্লাউশ হ্যাটটা লেডি ব্রুকসের মতো।’
মিসেস হিগিন্‌স উল বুনছিলেন, ববের কথায় চেয়ার ছেড়ে কিচেনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতেই হিগিন্‌স চোখের ইশারা করল।
—‘না হে, হবে না। আজ রাতের মতো সব শেষ। ঠিক আছে, নিগ্রো লোকটাকে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে পার তবে আমি ভেবে অবাক হচ্ছি, তুমি নিজেই ওর জন্য খাবার কিনে আনছ না কেন?’
মৃদু স্বরে শাপশাপান্ত করল বব। ঠিক আছে সে না হয় নিজেই খাবারদাবারের বন্দোবস্ত করবে। আপাতত বুড়োটাকে নিজের ঘরে নিয়ে যাওয়া যাক।

বব উইলিস ও একটি কালো কোটের গল্প- পর্ব ১

     গোটা শীতকালটাই বব বেশ ঝিমিয়ে কাটায়। ঘরের জানালা দিয়ে উদাস চোখে বাইরের বরফ পড়া দেখা ছাড়া তার কাজ বলতে শুধু খাওয়া এবং ঘুম। সন্ধ্যার দিকে অবশ্য সে চেস্টারের বিয়ার পাবে কদাচিৎ যায়। কদাচিৎ, কারণ জর্জটাউনের লম্বা চুলওলা মেয়েদের সে দু’চক্ষে দেখতে পারে না। সে জানে তার এই আয়েশি চালচলন বাড়িওয়ালা মিঃ হিগিন্‌সের পছন্দ নয়। তবে যেহেতু সে মাসপয়লা বাড়িভাড়া অন্য ভাড়াটেদের তুলনায় আগে দেয়, এবং প্রাতরাশের টেবিলে মিসেস হিগিন্‌সের লেস দিয়ে বোনা ফ্রেঞ্চ গাউনের প্রশংসা করে, তাই হিগিন্‌স তাকে কিছু বলে না। উপরন্তু মাঝেসাঝে তার জন্য এক বালতি বেশী গরম জল রেখে দেয়। প্রতিদানে, কখনো কখনো সে ক্রাম্যার্স লেন ধরে ব্রডওয়ের দিকে টহল দিতে গেলে, হিগিন্‌স দম্পতির জন্য মিষ্টি রুটিও কিনে আনে। তবে শীতকালে তার প্রথম পছন্দ বেকার্স ইনের কেক। ক্যান্টারবেরির কেকও তার ভালো লাগে তবে ওতে স্ট্রবেরি থাকে না।
     আমাদের গল্পের নায়ক বব উইলিস কোনো ভবঘুরে নয়। সে জর্জটাউন কোলিয়ারীর শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা। অবশ্য এর মানে এই নয় যে সে উডল্যান্ড পার্কে দাঁড়িয়ে, চোঙা হাতে, কোলিয়ারীতে কেন বছরে মাত্র দু’শ চৌত্রিশ দিন কাজ দেওয়া হবে, তার বিরুদ্ধে জোরদার সওয়াল করতে পারে। ওহাইয়ো আর মিসিসিপিতে যে শ্রমিকদের দ্বিগুণ মাইনে দেওয়া হয় এ খবরটাও সে জানে না। যেমন জানে না, হিগিন্‌সের বোনঝি মিস আন্যাবেল মেরী ক্যারোলাইনার দাঁতে ব্রেস রয়েছে। তবুও তাকে ইউনিয়নের নেতা বানানো হয়েছে, তার কারণ মালিকের মেয়ের সাথে তার একটু বেশীই খাতির।
     এমনিতে বব ছেলে ভালো। তার বাপ যখন তাকে হাইস্কুলের পাট চুকিয়ে কোলিয়ারীতে কাজে ঢোকালো তখন সে মোটেই আপত্তি জানায়নি। বরং প্রথম মাইনে পেয়ে সে একটা ছিপ কিনে সাত পাউন্ডের স্যালমন মাছ অবধি ধরতে পেরেছিল। মাসের প্রথমদিকে বন্ধুবান্ধবের পেছনে সে অকাতরে পয়সা ঢালে, যে কারণে বন্ধুরা তাকে খাতির করে ডাকে ‘আমুদে বব’ বলে। তবে তার সবথেকে ভালো লাগে কেন্টাকি ব্যালে থিয়েটার, বিশেষ করে ওর টিকিট মাস্টার বুড়ো বেনসন্‌কে। প্রতি রবিবার গীর্জাতে সে বুড়োর জন্য চুরুট নিয়ে যায়। আরাম করে বেঞ্চে বসে দু’জনে মিলে খোশগল্প করে। উত্তরে হ্যামন্ড শহরে চিংড়ীমাছের ব্যবসা খোলার বুদ্ধিটা বেনসন্‌ই ওকে দিয়েছিলো।
     ইদানীং কোলিয়ারীর অবস্থা খুব খারাপ। টন পিছু মজুরির হিসেব অনুযায়ী শ্রমিকদের যা পাওয়ার কথা তার অর্দ্ধেকও তারা পাচ্ছে না। কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে জ্যাকসনভিল এগ্রীমেন্ট অনুযায়ী কোলিয়ারী নাকি বন্ধ হয়ে যাবে। মজুরি কম পাওয়ায় কেউ আর কাজ করতেও চায় না। পুরোনো বাসিন্দারা সব এক এক করে সম্পত্তি বেচে চলে যাচ্ছে। গত গ্রীষ্মে সার্কাসও তেমন জমেনি। তবে ববের এসবে কিছু যায় আসে না, তার সকাল সন্ধে রুটি আর মদ হলেই চলে যায়।
     আমাদের গল্প শুরু হচ্ছে নভেম্বরের কোনো এক শীতের সন্ধ্যাবেলায় ক্রাম্যার্স লেনের সরাইখানাটির দোতলার এক ছোট্ট জানালা থেকে। ঐ জানালার পাশেই ববের প্রিয় ইজিচেয়ারটি রাখা। ওতে বসে বব একমনে পাশের বাড়ির চুল্লীটার ধীরে ধীরে বরফে ঢেকে যাওয়া দেখছিল। নীচে রাস্তাঘাট একরকম শুনশান। ক্রমশ পশমের তুলোর মতোন হাল্কা ছাইরঙা বরফে সবকিছু ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
     আজ বব সারাদিন প্রায় ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। একবারমাত্র কিছুক্ষণের জন্য সে ইউনিয়নের মাসিক পত্রিকা পড়ার চেষ্টা করছিল। বিশেষ করে, ‘রবিবার সন্ধ্যা’-র কলামটা যেখানে একগুঁয়ে টমাসের বউ নানান মুখরোচক হুজুগের হালহদিস দেয়। এছাড়া সে পড়েছে পাদ্রী সাহেবের গীর্জাসংক্রান্ত নানান ঐশ্বরিক চিন্তাভাবনা, কিংবা শহরের পুরোনো বাড়ি কেনাবেচার গল্প। অবশ্য ইউনিয়নের দাবিসনদ জাতীয় জটিল বিষয় সে ছুঁয়েও দেখেনি। তবে সবকিছুই তার বিরক্তিকর লাগছিল কারণ হ্যামন্ডে মাছের ব্যবসার বাজার কেমন, সেসব কিছুই এইধরনের পত্রিকায় পাওয়া যায় না।
     চুল্লীটার প্রায় পুরোটাই বরফে ঢেকে যাওয়ার পর ববের মনে হল জর্জটাউনে সে অনেককাল কাটিয়ে ফেলেছে। প্রতিসন্ধ্যায় হিগিন্‌সের পিয়ানোর বিরক্তিকর টুংটাং শোনার মতোই শহরটা একঘেয়ে। কোনো নতুনত্ব নেই। এমনকি ব্রডওয়ের ধারে জামাকাপড়ের দোকানের নতুন মালিকের বউও সেই একই মেরি উইডো হ্যাট পরে। বব দ্রুত ঠিক করল শীতের শেষে সে উত্তরের দিকে চলে যাবে। কোনো বন্দরে চাকরি নেবে। খালাসি কিংবা নাবিকের চাকরি হলে বেশ হয়। মাইনেপত্তর ভালো, তাছাড়া একঘেয়েমিটাও কাটবে। তারপর না হয় হাতে পয়সাকড়ি এলে সুবিধামতন টাটকা মাছের ব্যবসা খুলে জাঁকিয়ে বসা যাবে। বন্দর শহরের সুবিধা হল ওগুলো কখনো পুরোনো স্যাঁতস্যাঁতে হয় না।
     এইসব ভেবে বব একটু নড়েচড়ে বসল। সারাদিন ঝিমিয়ে থাকার পর একটু উত্তেজিত হওয়ার মতন রসদ পাওয়া গেছে। আলমারি খুলে সে বার করল উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একটা কাঠের বাক্স। খবরের কাগজের কাটিং, কিছু ডলারের নোট, খুচরো পয়সা, পারফিউমের শিশি ও আরও নানান টুকিটাকিতে যেটা প্রায় ভর্তি। আতিপাতি খুঁজে সে বের করল বহুদিন আগেকার বিজ্ঞাপনের কাটিং। ছোট্ট একফালি বিজ্ঞাপন। বন্দরের কর্মকর্তারা যেমন ডকইয়ার্ডে সাফাই কর্মীনিয়োগের জন্য দায়সারা গোছের নোটিশ লটকায়, অনেকটা সেরকম। বব যত্ন করে সেটাকে থুতু দিয়ে দেওয়ালে সেঁটে বিছানার উপর শুয়ে শুয়ে লক্ষ্য করতে লাগল।
‘এই রকম কিছু একটা আমার দরকার।’, বিড়বিড় করে বলে উঠল সে। ‘অবশ্য মাইনেটাও দেখতে হবে। তবে ঝাড়ুদার হিসেবে চাইলে ওরা বব উইলিসকে পাবে না। নাবিকের কাজই আমি ভাল পারব। হয়তো ওরা আমার কাজ দেখে মেট্‌ও করে দিতে পারে। ওঃ কি তোফা থাকা যাবে! দু’মাস অন্তর নতুন জায়গা, নতুন মদ, ডকইয়ার্ডে নতুন নতুন সব লোকজন, জাহাজঘাটার একপাশে শেডের ভিতর অফিসারদের ক্যান্টিন, দিলদরিয়া মেজাজের শিপমেটের চিৎকার, ‘এই বব, কম্পাস দেখ, নোঙর ফেল,’ টি আং লিং, আ হয় ক্যাপ্টেন, টি আং লিং…’
বব উইলিস পৃথিবীর অন্য সব উচ্চাভিলাষী যুবকের মত নয়, তাই সে এরপর দক্ষিণদেশীয় কোন ধনী মেয়েকে বিয়ে করে কাচ্চাবাচ্চার স্বপ্ন মোটেই দেখল না, বরং ফুর্তির চোটে বোতলটা শেষ করে চটজলদি স্থির করল চেস্টারের পাবে একবার ঢুঁ মারবে। ওখানে আজ বেনসনের আসার কথা। ওর সাথে পরামর্শ করতে হবে।
     বাইরে এখনো ক্রমাগত বরফ পড়ে চলেছে। প্রায়ান্ধকার রাস্তায় দু’ধারের গ্যাসবাতিগুলো এখনো জ্বলেনি। পথচলতি মানুষজন ঠান্ডার চোটে আপাদপমস্তক ঢাকা। গরম জামা, জুতো, মোজা, দস্তানা, টুপি, ওভারকোট চড়িয়ে ঘরের দরজা খুলতেই বব শুনতে পেল একতলায় হিগিন্‌সের বৈঠকখানায় পিয়ানোর রেওয়াজ শুরু হয়েছে।

Sunday, 17 July 2011

ভালবাসি যা কিছু- পর্ব ১

বাদলা করেছে। মেঘের উপর কালো রঙের পোঁচ। উস্কোবুড়ির চুল উড়িয়ে সোঁদামন জানালায় আঁচড় কাটেঢিমেতালে কচুপাতার জলকে্‌ চল সাজ। বুকের ভেতর আড়াল করা হলুদবরণ লাজ। এই সময় অনেক কিছু লিখব না বুঝি!
সত্যি হোক বা মিথ্যে। কোনো ল্যাজের গল্প, কোনো নেলপলিশের গল্প, কিংবা হুকে ঝোলানো ফতুয়ার গল্প। অথবা সেইসব বাঘবন্দী খেলার কথাগানের কলির কথাঘরের এককোনায় রাখা টি আং লিং দের কথা। আমি আবার লেখার আগে লেখা খুঁজি।
আসলে ওরা লুকিয়ে থাকে। ফিনফিনে সরু সুতোর মতো জড়িয়ে থাকে। আঁচলে, পকেটে, বাসের টিকিটে। সিগারেট কেসে চাপড় মেরে মৃদু হেসে খামচে ধরি। রেকাবিতে খাবার আসে। ফুলকো লুচি, বেগুনভাজা, হয়তো একটু সুজি।
আমি লেখার আগে লেখা খুঁজি। গায়ে গতরে, চোখ রগড়ে সুতো দিয়ে চরকা কাটি। চাঁদের বুড়িও চরকা কাটে। গল্প লেখে। সে গল্প ভাবে বাতাস কোথা? সে গল্প ভাবে হাঁটবে কোথা? অনেক দূরে তো কুটুমবাড়ী, সারি সারি পিদিম জ্বলা তুলসীতলা, ঘোমটা টেনে হাতছানি দেয় সন্ধ্যেবেলা। বুড়ির গল্প চলকে ওঠে, পানসি ভাসায় মাঝদরিয়ায়নোঙর লুকোয় উজানপানির ঘাটে। গল্পরা সব অমনি জেগে ওঠে। বাদলা মেঘে খুঁজতে থাকে আমার কলম দোয়াত। হুহু পাখির দুপুর বয়ে চলে, অনেক কিছু লেখার আছে বুঝি!
বরং লিখি পুকুরঘাটের কথা। পেয়ারাগাছের সঙ্গী পুকুরঘাট। ইঁট বাঁধানো ফাটলে বাঁচে যারা, শ্যাওলা মাখা পিছল পাখসাট। একটি দুটি ত্রস্ত ছন্দ পায়ে, বোল ধরিয়ে জলের ঢেউয়ে দেহ, চিকন গায়ে জলের ফোঁটার টিপ, ঘন্টাখানেক জলেই রাজ্যপাট। জল কি জানে ঘাটের সিঁড়ির কথা? জল কি জানে ঢোঁড়াসাপের বাস? জল কি জানে কেন সাঁঝের সময়, স্থবির থাকে যত দীর্ঘশ্বাস?
ঘাটের কথা আমিও কি ছাই বুঝি? সেসব জানে চরকাবুড়ির গল্প। সেসব জানে নোংরা ঝোপে ডাহুক, সেসব জানে পদ্মপাতা শালুক। আমি কেবল অসীম চোখে দেখি। রঙের ছোপে আঁচড় কেটে ভাবি, পুকুরঘাটের রংটি যেন কেমন। নীলচে সবুজ হয়তো বেগনি অল্প।
তারচেয়ে লিখি খাটপালং-এর গল্প নকশা করা সেগুনে জমানো স্মৃতিস্মৃতির ভেতর কত দূরের রেশ। স্মৃতির ভেতর ময়লা কত দিন। চরকাবুড়ির গল্প জানে শুধু, কেমন করে শায়িত রাত্রিদিনদিনের শেষে খাটপালং এর জলে, ছায়ার মতো লুকিয়ে থাকে ভোরকুঁচকে থাকা চাদর মাখে সোহাগ। সোহাগ শেষে ঘুমজড়ানো ঘোরচরকাবুড়ি চরকা কেটে চলে, আমি শুধু গল্পগুলো খুঁজি।
বাদলা মেঘে কালো রঙের টান। হাওয়ামনে জানালা আঁচড় কাটে। জলকে্‌ চলা সাজের কচুপাতা, বুকের ভেতর উদোম হয়ে হাঁটে। এমন দিন মিথ্যে কথার দিন, এমন দিনে লিখতে হবে না বুঝি!

সবুজ পাপ-শেষ পর্ব

রেললাইনের দুপাশ সারি দিয়ে পুকুর। একসময় রেললাইন উঁচু করার জন্য দুধার থেকে মাটি কেটে লাইনে ফেলা হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে জল জমে এখন তা রীতিমতো পুকুর। রেলপুকুর শেষ হলে দুটো একটা নারকোল কি সুপুরি গাছ। তার পেছনে সার দিয়ে জননবসতি। একতলা দোতলা বাড়ী, বাড়ীর ছাদে অ্যান্টেনা, বাড়ীর পাশে লেভেল ক্রসিং, মুদীখানা। ছোট ছোট জনপদ। শহরতলী। মধ্যবিত্ত মানুষজনের মাথা গোঁজার ঠাঁই।
     সিদ্ধার্থ জানালার ধারে বসে কাস্তে হাতুড়ী গুনছিল। তার উল্টোদিকে একটা চিমড়ে মার্কা লোক বসে। হাতের কনুইয়ে পুঁজ। ফুটিফাটা জামা। লুঙ্গির ট্যাঁকে হলদেটে কাপড়ের পুঁটলি মত। কোমরে গামছা বাঁধা কান্নিক। রাজমিস্ত্রী বোধহয়। কাজকর্ম সেরে হয়তো বাড়ী ফিরছে। পাশে ময়লা কাপড়ের ব্যাগ রাখাএকটু পরে সেখান থেকে একঠোঙা মুড়ি বের করে লোকটা একমনে চিবুতে লাগল
      সিদ্ধার্থ একটু বিরক্ত বোধ করল। সে একটা দুঃসাহসিক কাজ করতে চলেছে। কোথায় একটু লো আঙ্গেল থেকে ক্যামেরা শট্‌টা নেবে, হালকা জুম করে চোখের ঘোলাটে দৃষ্টির দিকে প্যান করবে, সাথে ভেসে আসবে হালকা উন্মাদক সুর, তা না খালি মুড়ি চিবোনোর কচর মচর শব্দ শুনতে হচ্ছে। এ লোকটার কাছে জীবন মানে হচ্ছে এই নৈহাটি লোকালে জানালার ধারের কচরমচর। উঁহু, একটু উদাস সুর আনতে হলে মুখের সামনে এই উপদ্রবটিকে বরদাস্ত করা চলবে না।
      সিদ্ধার্থ উল্টোদিকের জানালার ধারে এসে বসল। এদিকটায় চড়া রোদ। সামনের সীটে পায়ের ওপর পা রেখে সে চেষ্টা করল একটু আয়েশ করার। বাইরে নিস্তব্ধ দুপুরে আলোর বন্যায় ভাসছে ইঁট কাঠ পাথর। সিদ্ধার্থ দেখল, এধারের রেলপুকুরের জলে ছায়া পড়েছে। হাঁস চরছে। বিস্রস্তবসনা হয়ে কেউ পুকুর ঘাটে আছাড়ি দিয়ে কাপড় কাচছে। পাশে কঞ্চিপাতা ঝোপের পাশে শুকনো ঘুঁটের সারি। পায়ে হাঁটা রাস্তার পাশে পানপরাগের প্যাকেট। রেলপুকুরের পাশে দোতলা বাড়ির বারান্দায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। লাফঝাঁফ দৌড়োদৌড়ি চীৎকারদূরে একরঙা সারি সারি ফ্ল্যাট। টেলিফোন অফিসবাড়ীর ছাদে মোবাইল টাওয়ার। পায়রা উড়ছে, পায়রা নামছে। স্টীল লাইফ। স্ন্যাপশট্‌স। ফাইভ কি সিক্স ফ্রেমস পার সেকেন্ড। মিঠে ঘটাং ঘট শব্দ তুলে রেললাইনরা বুড়ি ছুঁয়ে পালিয়ে যায়
      সেও পালাতে পারত। বনামীকে ভালবাসে না সে? তুমুল দায়বদ্ধতার কাছে মাথা নীচু করে দিব্যি সরে আসতে পারত। চতুষ্পদরা যেমন এক ঝটকায় জল ঝেড়ে ফেলে, তেমন করে। তার বদলে এই বুড়ি ছোঁয়ার ইচ্ছেটুকুকে এত আমল দেবার কারণ কী? চেষ্টা করেও তো খুঁটি উপড়ানো যাবে না।
      সিদ্ধার্থ চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করল অন্য স্পেস টাইম কার্ভেচারের প্যারালাল ইউনিভার্সে তার কাউন্টার পার্ট কি ভাবছে এই সময়। সেও কি চড়ে বসেছে নৈহাটি লোকাল? তারও কি গন্তব্য এক? তার বনামীও কি একই রকম পজেসিভ, বাংলা অনার্স এবং নাকিকান্না সিরিয়াল টাইপ?
      ফের দ্বিধা। মনের ভেতর থেকে থেকে যাবতীয় নীতিকথা বোধ ধাক্কা মারছে। ইস্‌ তুমি না কমিটেড। সুনির্দিষ্ট লজিক্যাল রিজনিং মেনে চলা কর্তব্যনিষ্ট পুরুষ। অজানা অভিসারের অনুমতির প্রশ্নটাই তো অর্থহীন। ডেডিকেশন কই সিদ্ধার্থ? ডেডিকেশন?
      ট্রেনটা ট্রাক চেঞ্জ করল। গতিও কমল মনে হচ্ছে। কোন স্টেশন আসছে কী? হ্যাঁ সোদপুর। সবুজ বেড়া দেওয়া প্ল্যাটফর্ম। গুটিকয়েক লোক, শেডের তলায় উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে। স্টেশনে চায়ের স্টলের শাটার খুলছে কয়েকজন। মৃদু হাওয়ার সাথে অচেনা পাখির হু হু ডাক। নিঝুম দুপুরযাত্রায় আর বাকী মাত্র কয়েকটা স্টেশন। সিদ্ধার্থ টানটান হয়ে বসল।
      নিজেকে বোঝানোর মতো কিছু এক্সকিউজ দরকার। এই অদ্ভুত ঝড়ের মূলে তৈরী হওয়া বাটারফ্লাই এফেক্টটা আসলে কী? খেয়াল খুশি আদিখ্যেতা? শ্রবণার কাছে ঘেঁষার প্রতি মোহ? নাকি সিদ্ধার্থ বসু সেইসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করছে যার ব্যাখ্যা তাবড় মনস্ত্বত্ববিদদের নাগালের বাইরে। এই দিনের, এই ঘটনার অভিজ্ঞান হিসেবে সে কোনটিকে মনে রেখে দেবে?
      বাড়ী ঘর দোর হুহু করে ছুটে আসছে। পড়ন্ত দুপুরে রোদ নেমে এসেছে মাটির কাছে। নানান ফাঁকফোঁকর দিয়ে আলো এসে উথলে উঠছে সিদ্ধার্থের চোখে মুখে, হাতের চামড়ায় চোখ বুজে রোদ মাখতে লাগল সে। মনের ভেতর মনের সাথে ঝগড়া চলুক, সে না হয় লজ্জা গুলো অন্যখানে পোষমানাবে।
      আরো একটা স্টেশন ছুটে এল। সেই একই সবুজ বেড়া, ফ্যাকাশে শেডের চাল, চায়ের স্টল, খবরের কাগজের সারি। তবে এটা আরো নির্জন। স্থির প্ল্যাটফর্মে বড় সাবেকি ঘড়িখানা খালি সময় বহন করে চলেছে। বাতাসে অনাঘ্রাতা গন্ধ।
      সিদ্ধার্থ জানালা দিয়ে উঁকি মেরে স্টেশনের নামটা দেখার চেষ্টা করল। হিসেবি মতে ঠিক এর পরেরটাই হল তার গন্তব্য। ই টি এ ফাইভ মিনিট্‌স।
      স্টেশনের পেছনেই ছোট কোয়াটার মতন। টিনের চালাঘর। বাইরে জল খাবার পাইপ ও কল। বারান্দায় সুখী ঘরের কাপড়চোপড় ঝোলানো। তীব্র অসুখী চোখে সেদিকে তাকাতেই সিদ্ধার্থ লক্ষ্য করল একটি বৃদ্ধ বলিরেখা সম্পন্ন কোলকুঁজো চেহারা বারান্দায় বসে ঝিমোচ্ছে।
      কতক্ষণ ট্রেন থামে এখানে? একমিনিট, দুমিনিট? সিদ্ধার্থর মনে হল, সে যেন অনন্তকাল ধরে এখানে থেমে আছে। চারিদিক কি ভীষণ রকম শান্ত। ট্রেনের ভেতরকার মুড়িজাত কচরমচর বহুক্ষণ আগে থেমে গেছে। গুবগুবি পাখির ডাক বেয়ে আলটপকা গরম বাতাস এসে লাগছে মুখে। লাইনের ওপর পড়ে থাকা ইতস্ততঃ প্লাস্ট্যিকের কাপ ছড়ানো ছিটোনো। সিদ্ধার্থ উষ্ণতার খোঁজে বুড়োটার দিকে তাকাল।
       নিরীহ ঝুঁকে পড়া মুখ। চোখ বোজা। গায়ে ময়লা গেঞ্জি। বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়া দেহ। টুলের ওপর কোনমতে হাত দিয়ে দেহটাকে ধরে রেখেছে। মাথায় অল্প কিছু চুল, তাও সাদা। গালে বহুদিনের না কামানো অযত্ন। রোগাটে দেহের তুলনায় মস্তিষ্ক কিছুটা বড়। অন্ততঃ ফোরহেড। চোখ বুজে কী ভাবছে ওই বুড়ো? যৌবন বয়সের কথা? নিজের ডানপিটেমোর কথা? নিজের বাপমায়ের কথা? নাকি ও স্রেফ মানসিক ভাবে বন্ধ্যা? ব্ল্যাঙ্ক জগত নিয়ে স্রেফ মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষারত।
       ট্রেন ছেড়ে দিল।
সহসা, অনুভূতিটা গাঢ় হল। রোম খাড়া হওয়া শিরশিরানি নামল শিরদাঁড়া জুড়ে। বহুযুগ পরে কোন এক দুপুর বিকেলে সেও তো বসে থাকবে এমনি ভাবে কোন টুলের ওপর। জরাগ্রস্ত। তার মাথায় থাকবে হয়তো কিছু অল্প সাদা চুল, গালে থাকবে বহুদিনের না কামানো দাড়ি। কোনমতে দেহটাকে বাঁচিয়ে রাখবে সে চরম মুক্তি থেকে। সেই সময় বলিরেখা জড়ানো মুখে কোন চিন্তার জপমালা গুনতে হবে তাকে? কি ভাববে সে সেইসময়? কোন অমূল্য গোপন স্মৃতির বয়াম খুলে সন্তপর্নে বার করবে রুপোলী জিয়নকাঠি? চোখ বুজে ঢুলে ঢুলে পড়ে যাওয়ার আগের মুহূর্ত অবধি যে লুকোনো ট্রেজার তাকে নিশ্চিত মৃদুভাবে ছুঁয়ে থাকবে।
        সিদ্ধার্থ বসু উঠে দাঁড়ালো। ট্রেন ছুটে চলেছে। আর বড়জোর কয়েক মিনিট। তারপর স্বাভাবিক মন্দন শুরু হবে। ফের ফ্রেমে উঠে আসবে হয়তো একই রকম সবুজ বেড়ার স্টেশন। তারপর হয়তো শুরু হবে নিজেকে সরিয়ে রেখে নিজেকে দেখা। শ্রবণার সাথে দেখা হোক বা নাই হোক, উদ্দিষ্টের দিকে সে একাই হেঁটে যাবে। প্রানপণে মনে রেখে দেবে সমস্ত পদক্ষেপ। বদলে যাওয়া চিত্রপট। সে নির্ধারিত করবে তার বৃদ্ধ বয়েসের ‘আফটারনুন ড্রিম’সিদ্ধার্থ বসু তার ভবিষ্যতের প্রত্যেকটি দুপুর কে শনাক্ত করে ফেলবে পরবর্তী কিছু সময়ে
        ট্রেনের গতি কমে এসেছে। সিদ্ধার্থ সামান্য টলতে টলতে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। সবুজ বেড়ার প্ল্যাটফর্ম ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। বৃথাই সে এতক্ষণ নিজের সাথে ঝুঝছিল। প্রত্যকের দরকার থাকে একটা গোপন অপরাধবোধ। শেষজীবনের রোমন্থনের রসদ। প্রতিটা মানুষ তার নিজস্ব সবুজ খাতায় লিখে রাখে এ রসদের প্রতিটি হিসেব। সেই বা ছুঁড়ে ফেলে দেবে কেন এ অযাচিত বাটারফ্লাই এফেক্ট?
         ট্রেন থেমেছে। সিদ্ধার্থ অনুভব করল, তার দেহের প্রতিটি বিন্দুতে কোয়ান্টাম স্পুকি এফেক্ট। আইনস্টাইন বোকা ছিলেন। একপশলা উদ্দাম হাওয়ার সাথে সে টের পেল, প্যারালাল ইউনিভার্সে তার কাউন্টারপার্টটিও নৈহাটি লোকালের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
         মৃদু হেসে, আমাদের গল্পের নায়ক সিদ্ধার্থ বসু সবুজ বেড়ার প্ল্যাটফর্মে নেমে এল।

সবুজ পাপ-পর্ব ২

শিয়ালদা স্টেশন শেষ দুপুরে একটু ফাঁকাফাঁকা। মানুষজনের হাঁটার গতি বেশ স্লথ। অফিস কাছারির লোকজন সব বিকেল থেকে ভীড় জমাতে শুরু করবে। আপাতত কিছু নিশ্চিন্তমনা সুটকেস সহ স্বামী ও বাচ্চাকোলে স্ত্রীদের ইতস্ততঃ প্যাকেজ। কোথায় যাচ্ছে সব? শ্বশুরবাড়ী?
     সিদ্ধার্থ একটা ভিখিরি বুড়োকে দুটো পয়সা ছুঁড়ে দিয়ে স্টেশনগুলোর নাম লেখা বোর্ডটার দিকে তাকাল। নিচেই টিকিট কাউন্টার। এই স্থল হইতে শহরতলীর সমস্ত স্টেশনের টিকিট পাওয়া যাইবে। তা ভাল। সমস্ত নয়, সিদ্ধার্থর শুধু একটা নির্দিষ্ট স্টেশনের টিকিট দরকার। ওই যে থার্ড রো, লাস্ট কলাম। নামখানা জ্বলজ্বল করছে। ওইটিই হলো তার গন্তব্য।
     মিনিট কুড়ি পর একটা ট্রেন রয়েছে। নৈহাটি লোকাল। তারপর ঘন্টাখানেক পরে আরো একটা। তারপর আরো। আরো। দিবানিশি নৈহাটি লোকালরা চলে ফিরে বেড়ায় স্টেশন থেকে স্টেশনে। লোক ওঠে, কত লোক! ঠাসা ভীড়ে প্রত্যেক হাঁস মুরগীরা মুখ উঁচু করে শ্বাস নেয়। পাদানির হাতল ধরে ঝুলতে ঝুলতে ঠিক দেখে ফেলে নিজেদের বঞ্চিত জীবন। গলা বুক জ্বলা ভীড়ে, এ ওকে ধাক্কা মেরে লোক নামে, কত লোক! একদল নেমে গেলে আরেকদল উঠে আসে। প্রাণপণে লড়াই চালিয়ে ওরা হয়তো কখনো খুঁজে পায় শেষতম সিটের আভাস। পাদানির হাতলের মালিকানা বদল হয় শুধু। নতুন পোশাক পরে নৈহাটি লোকালরা স্টেশনে স্টেশনে খোঁজে উচ্ছিষ্ঠ প্রাণ
     সিদ্ধার্থ নৈহাটি লোকালকে পছন্দ করে ফেলল। ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে ছ নম্বর প্লাটফর্মে। শেডের ফাঁক দিয়ে চলকে পড়া রোদ লেগে রয়েছে গায়েট্রেনটা ঝিমোচ্ছে।
     হাতে ধরা টিকিটটার দিকে তাকিয়ে সিদ্ধার্থ ফের দোটানায় পড়ল। কাজটা কী ঠিক হচ্ছে? এরকম হুট্‌ করে শ্রবণার বাড়ী চলে যাওয়া কী ঠিক হবে? সে তো সিদ্ধার্থকে প্রায় চেনেই না বলতে গেলে। কোনোদিন কথাও বলেনি মুখ ফুটে। হাই হ্যালো নয়, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং নয়, গায়ে পড়ে আলাপটুকুও নয়। কোনো সুযোগই আসেনি ফোন নম্বর চালাচালির। শ্রবণা জানেই না সিদ্ধার্থ বসু কে? এরকম আচমকা অঘটন সংক্রান্ত প্রতিবর্ত ক্রিয়া ঠিক কী হতে পারে? সাইকলজির পেপার গুলোয় কোন ক্লু পাওয়া যেতে পারে কী?
     অবশ্য সিদ্ধার্থ শ্রবণার সব কিছু জানে। মানে যতটুকু জানা যায় আর কী। ফোন নম্বর, ইমেল, বাড়ীর ঠিকানা, বাবার নাম আর পেশাগুগল ম্যাপ থেকে বাড়ীতে যাওয়ার পথ নির্দেশ। কোন স্কুলে পড়েছে, বাড়ীতে কে কে আছে, কোথায় নাচ শিখেছে, লেডিবার্ড সাইকেল আছে কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি অবশ্য জানে না, কেন সে মাথা নীচু করে মনমরা হয়ে হাঁটে? কেন মিষ্টি খেতে ভালোবাসে না? কেন ও মুছতে চায় না ওর মফস্বলের গন্ধ, কেনই বা ও হাতব্যাগে লুকিয়ে রাখে ওর ছোট বেলার পেন্সিলে আঁকা ছবি। কে জানে এসব? এই যে, নৈহাটি লোকাল, পিতমহ ভীষ্মের মত পড়ে আছ, আপাত পরিত্যক্ত, জানো নাকি এসবের হদিস?
      আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এই প্রশ্নোত্তর পর্ব আর্মহার্স্ট স্ট্রীট থেকে শুরু হয়েছে। ঐ যে, মিউজিক্যাল ব্যান্ডপার্টির দোকানগুলো আছে না, জগঝম্প ড্রাম স্যাক্সোফোন ইত্যাদি নিয়ে ফি দিন মকশো করে, ওই খানেই, সামান্য টুকরো ইঁটে হোঁচট খাওয়ার পর থেকেই। তার আগে তো রীতিমতো রিহার্সাল চলছিল। শ্রবণা কেমন তাকে দেখে চমকে যাবে। রীতিমতো সংলাপ বলার মতো করে বলতে হবে দুদন্ড শান্তি দাও হে নাটোরের বনলতা। তারপর কিছু সহানুভুতি জর্জিত সংলাপ ও একদম ঘেঁটে যাওয়া কোন বিকেল।
     আসলে কীই বা বলার আছে তার? কেন সে যেতে চায় শ্রবণার কাছে? সুস্থ সবল দুকেজি ওজনের প্রেম, মাসপয়লা টিউশনির টাকা, বাপের হোটেলে ফি দিনের খোরাকি এসব কী কম হল সুখে থাকার জন্য। তার জীবনে দুঃখ কোথায়? প্রাণপণ খুঁজেও সে কী বার করতে পেরেছে কোন লুকোনো অসুখী মন, যার জন্য ধরা গলায় নানান কাঁদুনি গাওয়া যায়। খুঁটিকে অস্বীকার করার মতো সাহস বা মুরোদ কোনটাই তার কাছে নেই, তাহলে এই ধীরে ধীরে পেরিমিটারের দিকে এগিয়ে যাওয়া কেন?
     মুশকিল হচ্ছে, হোমোস্যাপিয়েন্সরা দ্বিধায় পড়লে থমকে দাঁড়ায়, সিদ্ধার্থ বসু কিন্তু ধীরে ধীরে শিয়ালদার দিকে এগিয়েছে। হোঁচট খাওয়ার পর থেকে যতবার মনে হয়েছে, এমন করাটা পাগলামি, তত যেন গতি বেড়েছে তার। এই অনাস্বাদিত অ্যাডভেঞ্চারটা যেন ভীষণ রকম দরকার, কিন্তু শত চেষ্টা করেও কারণ খুঁজে পায়নি সে।
কলেজ স্কোয়ারের স্থির বেঞ্চিও কোন হদিস দিতে পারেনি, দ্রুত গতিশীল দোকানপাটও নয়। আসলে এ হয়তো নিজের কাছে একরকমের পরীক্ষা। কতদূর যেতে পারে সে? বেস ক্যাম্প, নর্থ কল না কি একেবারে সামিট। একবার দুঃসাহসী হয়েই দেখা যাক না। বনামী তো আর জানতে পারছে না রে বাবা।
     অতএব, নৈহাটি লোকালের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সিদ্ধার্থর মনে হল, এই অলস ট্রেনটার জীবনে কিছু বৈচিত্র্য আনা দরকার। নৈহাটি লোকাল জানুক সে আজ এক বিপ্লবীকে টেনে নিয়ে বিপ্লবের দোরগড়ায় হাজির করানোর মহান সুযোগ পাচ্ছে।
      চট করে ট্রেনে উঠে ছায়াময় জানালার ধারে বসে পড়ল সে। মোবাইল সুইচ অফ করল। পকেট থেকে রুমাল বার করে মুছে নিল ঘাম। হাতঘড়িতে দেখে নিল সময়। তারপর মানিব্যাগ খুলে টিকিটটা যত্ন করে ঢুকিয়ে রাখল খোপের ভিতর
     এই টিকিটটা সে আজীবন রেখে দেবে। লুকিয়ে। বনামী কখনো টের পাবে না এই টিকিটের কথা।

সবুজ পাপ-পর্ব ১

বইপাড়া চত্ত্বরে সিদ্ধার্থ ঘুরতে ভালোবাসে। নতুন পুরোনো বইয়ের গন্ধ, বিকিকিনি, প্লাস্ট্যিকের প্যাকেটের ভেতর ঝকঝকে মলাটের উঁকিঝুঁকি, ইস্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী, কৌতুহলী লোকজন, সবকিছু মিলেমিশে কেমন সাড়ে বত্রিশভাজা। নেশার মতো। এলোমেলো ঘুরপথে এ গলি, ও গলি, সে গলি ছাপাখানাছাপাখানা শেষে বইবিপণির প্রত্যন্ত কোনার তাক। প্রতিটি পাতার ভাঁজে কত অজানা নতুন ঘুম। এবং ঘুম শেষে যত ফালতু বিকেলে ফিরতি ডাকের বাস।
     সিদ্ধার্থ এসবে ক্লান্ত হয় না। এ হল নেশাড়ু চরিত্রের অন্যতম দিক। কলেজের ছুটি ছাটা, ফাঁক ফোঁকর পেলেই সটান তীর্থভূমিতে এসে হাজির। ফুটিফাটা রোদ, তুমুল বৃষ্টি, ঝড়জল, বন্‌ধ, ঘেরাও উপেক্ষা করে এই অদ্ভূত আকর্ষণের কী মানে? নাকি এসব তার জিনে ইমপ্রিন্ট? আদিম মানুষের মতো যাযাবরবৃত্তি, বই থেকে বইয়ে ?
     শ্যামাচরণ দে স্ট্রীটে দুপুরের রঙ ধরতেই সিদ্ধার্থ স্থির করল, কোনো প্যারালাল ইউনিভার্সে তার কাউন্টার পার্টও নিশ্চয়ই একই রকম ভাবে নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে এই ভার্জিন মেরীর স্বাদ নেয়বাসের টিকিট হাতঘড়ির রিস্টব্যান্ডে গুঁজে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটে। ইউনিভার্সিটির পাশের ফুটপাথে জহুরী চোখে খোঁজে অমূল্য রতন। প্রশ্ন হচ্ছে সেই কাউন্টার পার্টটিও কি একই রকম বিপর্যস্ত? ন্যাকা ন্যাকা, একটু বোকা মতন? ক্লিশে নাটুকেপনা নিয়ে মাথা ঘামায়? আফশোস করে? নাকি তার চারপাশ ঘিরে রয়েছে সাফল্যের ওম। রয়েছে তুখোড় স্মার্টনেসে অর্জিত স্নবারি। হয়তো অন্য বিশ্বে সে খাতির পাচ্ছে প্রতিভাবান ছাত্র সিদ্ধার্থ বসু হিসেবে। এবং সবচেয়ে বড় কথা সাদা চুড়িদার নীল ওড়না মাখা কিছু পলকা মুহূর্ত তার কাছে হয়তো সহজলভ্যহয়তো একটু বেশীই
     এতসব ভাবার কারণ হল, সিদ্ধার্থ ভাবতে ভালোবাসে। আলগোছ অলস ভাবনা চিন্তা নয়। ঐ অন্যমনস্ক হয়ে পথচলতি মানুষের ভীড়ে সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হেঁটে যাওয়া, এ তার বড় পছন্দের। বইপাড়া চত্ত্বরে এরকম ভাবুক লোকেদের জন্য বিশেষ খাতির আছে। আচমকা হুমড়ি খেয়ে গায়ে পড়লে কেউ কিছু মনে তো করবেই না, উলটে হাত থেকে পড়ে যাওয়া খাতাপত্র কুড়িয়ে নিয়ে হয়তো মৃদু হেসে উঠবে। পরক্ষণেই তীব্র ম্যাসকুলিন নাক সচকিত হয়ে উঠবে ফেমিনিন পারফিউমে। অপ্রস্তুত হাসি হেসে একপ্রস্থ ক্ষমা চাওয়ার মাঝে মনে হবে, ‘যাঃ শালা, এ এতদিন কোথায় ছিলো?’
     আজকে এসব কিছুই ঘটছিল না কারণ সিদ্ধার্থ বসু তার মধ্যবিত্ত জীবনের ফাঁকে কোন একসময় আবিস্কার করে ফেলেছে যে, তার জীবনে প্রেম এসে পড়েছে। একেবারে সিপাই সান্ত্রী ঢাল তলোয়ার সমেত। জীবনে দ্বিতীয়বার। হুড়মুড়িয়ে এবং প্রেমের পিছু পিছু এসে পড়েছে যত রাজ্যের অপরাধবোধ। সিদ্ধার্থ নিশ্চিত জানে এরপর ক্রমান্বয়ে অবধারিত ভাবে হাজির হবে কিছু উদ্দামতা, সিনেমাসূলভ বৃষ্টি ভেজা এবং সবশেষে সর্দি জ্বর, সাইনাস, একগাদা ওষুধপত্তর, ইত্যাদি, ইত্যাদি। সুতরাং কলেজ স্কোয়ারের বেঞ্চিতে বসে কাঙ্খিত বর্ষার জন্য অপেক্ষা করা আর নিস্তরঙ্গ অপরাধবোধে ভোগা ছাড়া তার আর কাজ কী? রুটিনমাফিক টহলদারি শিকেয় তোলা থাক।
     কিন্তু অপরাধবোধ কেন? আসলে খুঁটি বাঁধা অবস্থায় দিশী গরুদের বেশী দূর যেতে নেই। পাড়ায় প্রেম করবে, ভালোবাসা-টাসা ইত্যাদিকে একেবারে প্রাতঃস্মরণীয় করে তুলবে, আবার কলেজের পয়লা বোশেখের অনুষ্টানে কোনো এক চিত্রাঙ্গদা দেখে ঐসব ইয়ে টিয়ে ভেবে রাতকাবার করবে, এ কি ‘মেরিক্যান ড্রিম’ পেয়েছো! তারচেয়ে হাহুতাশ করো। প্লট খোঁজো। বেছে নাও সাপ কিংবা লাঠি। তারপর দংশিত হতে হতে কোনো একসময় চীৎকার করে বল স্বাভাবিক কিছু ‘ধুত্তোর’
     মোদ্দা ব্যাপারটা ঘটেছে হপ্তাদুয়েক আগে। নববর্ষ জাতীয় কিছু আদিখ্যেতা ছিল কলেজে। এইসব অনুষ্ঠান সে ফি বছর মন দিয়ে দেখে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের রূপান্তর লগ বুকে নোট করে। তবে কবিতাপাঠের চক্করে পড়ে না। বড়জোর দরকারে নাটকের দলকে দাড়িগোঁফ সাপ্লাই দেয়। মোটামুটি একজন সহজ সরল ক্যাবলা টাইপ, যাকে কক্ষনো কেউ খেয়াল করে না। কিন্তু এরাই কখন চুপসময়ে প্রেমে পড়ে যায়। গাছ থেকে টুপ করে পাতা ঝরে, শিশির কখন জমে ঘাসের আগায়, দিগন্ত বিস্তৃত চিল নিঃশব্দে ঢেকে দেয় বিকেলের সূর্যপালক, আর ‘নেই মানুষ’রা অবয়ব খুঁজে পায় অন্যের ঘ্রাণে, এই তো ব্যাপার!
সুতরাং, গ্রীনরুমের পাশে, ঐ যে পাউডারের গন্ধ ছড়িয়ে, নাচের ড্রেস সামলাতে সামলাতে, ঘুঙুরের লঘু চপল আওয়াজ মেখে, কারো লক্ষীমন্ত পায়ে হেঁটে প্রেম আসবে, এ আর এমন কথা কী? ঠিক কি হয়েছিলো মনে নেই। মোটকথা অনুষ্ঠানের পুরো সময় সিদ্ধার্থ বসু চুপ করে নাটক দেখেছে, অন্ততঃ তিনবার সিগারেটের কাউন্টার ফিরিয়েছে, একবারও উঠে ইয়ে করতে যায়নি, এবং হাঁ করে দেখেছে কোনো এক শ্রবণা চ্যাটার্জী চিত্রিত হচ্ছে কত্থকীয় মুদ্রায়শরীরে বিভঙ্গ উঠছে, বোলের তালে তালে দুলছে কথার শরীর, রূপের নাচন লাগছে অবর্ণনীয় হুরি পরী জিন্‌ দেহে। পরিচিত ভালোলাগাগুলো ক্রমশঃ এসে ভীড় করেছে স্রোতের মতো।
     এতোটুকু যথেষ্ট ছিলো সিদ্ধার্থ বসুর কাছে। পরবর্তী কিছু হপ্তা ধরে সে মেতেছিল তথ্য সংগ্রহের খেলায়। নাহ্‌, ‘এই, মালটা কে রে?’ জাতীয় ব্যাপার নয়, বরং অনেক নিশ্চুপে। সন্তপর্ণে। বাক্সে লেখা ‘ফ্রাজাইল’ এর মতো, যত্ন করে। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা অপরাধবোধকে দাবিয়ে রেখে। এ এক ধরণের খেলা। নিজেকে সযত্নে সরিয়ে রেখে নিজেকে ভাঙার খেলা। অবশ্যই সে সফল বলতে হবে কারণ বনামী তো একটুও টের পায়নি।
     এ খেলা কিন্তু বেশ। ভলডেমর্ট নিজেকে সাতভাগে ভেঙেছিল, সে ভেঙেছে মোটে দুভাগে। একভাগ আত্মার সাথে কিছুটা জড়বস্তু না হয় সে বনামীকে দিয়ে দেবে। কিন্তু অন্য ভাগ না হয় তার কাছেই থাকুক।
     কলেজ স্কোয়ারের বেঞ্চিতে বসে গা এলিয়ে সিদ্ধার্থ টেলিপোর্টেশনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলতার কাউন্টারপার্টিটির কী অবস্থা এখন, অন্য বিশ্বে? তার জীবনেও কী বনামী জাতীয় কিছু আছে?