শীতের রাতের জর্জটাউনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানকার লোকজন সব ঘরের ভেতর ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে পুরনো দিনের স্মৃতিচারণা করে। দূরে, গীর্জা থেকে ভেসে আসা ঘন্টাধ্বনি এবং কয়্যারের শব্দে তাদের সাধারণত মনে পড়ে নিজেদের সুখী দিনগুলোর কথা। এসব ভেবে তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবং শপথ নেয় আসন্ন বসন্তে অবশ্যই কোথাও তারা দলবেঁধে পিকনিকে যাবে।
এই কথাগুলো বলার কারণ আমাদের গল্পের নায়ক বব উইলিস এই সমস্ত স্বাভাবিক সুখী ভাবনা ছেড়ে একটি অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল। কাজটি যে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কঠিন ও পরিশ্রমসাধ্য তাতে তার কোনো সন্দেহ ছিল না। তাই নিগ্রো বুড়োর মৃতদেহটা বস্তাবন্দী করে টেনে হিঁচড়ে রাস্তার শেষে বড় জঞ্জালের স্তূপের সামনে এনে ফেলে সে পরিতৃপ্তির হাসি হাসল।
এই অবস্থায় তাকে কেউ দেখেনি। দেখা সম্ভবও ছিল না, কারণ জর্জটাউনের লোকেরা এত বোকাও নয় যে ঘরের ভেতর নিশ্চিন্ত আগুনের উত্তাপ ছেড়ে বরফঠান্ডা সিটিহল অ্যালির এককোণে কি হচ্ছে তার খোঁজ নেবে। হাঁফাতে হাঁফাতে বব নিজের অদৃষ্টকে গালমন্দ করছিল।
কত রাত হবে এখন? রাস্তায় জনপ্রাণী নেই। নিঝুম জর্জটাউনের অলিতে গলিতে শুধু হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ। রাত্রের নিজস্ব আলোয় দেখা যাচ্ছে বাড়ীঘরের জানালা দরজা বরফে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। হয়তো কাল সকালে রেডিওতে ওরা ঘোষণা করবে মরসুমের সবচেয়ে বেশী তুষারপাত গতকালই হয়েছে। বব লক্ষ্য করল, বরফের উপর বস্তাটাকে টেনে হিঁচড়ে আনার দাগ তৈরী হয়েছে। এতে অবশ্য সে ঘাবড়াল না কারণ সে জানে এই দাগ মুছে যেতে বেশী সময় লাগবে না।
বস্তার মুখ খুলে সে একবার দেখল বুড়োর মুখটা। মাংসের টিনের কৌটোয় যেরকম হাস্যকর গবাদি পশুর ছবি দেওয়া থাকে ঠিক সেরকম। চোখ দু’টো এখনো খোলা। ববের মনে একটু করুণার উদ্রেক হওয়াতে সে হাত দিয়ে বুড়োটার চোখ দু’টো বুজিয়ে দিল।
—‘ঈশ্বর করুণাময়, ও আজ রাতেই মারা যেত। আমি শপথ করে বলতে পারি আমার কোনো ভূমিকা ছিল না এতে।’
স্বগতোক্তি করল বব। হঠাৎ মনে এলো বেনসনের কথা। সে নিশ্চয়ই আজ চেস্টারের পাবে ববের অপেক্ষায় ছিল। বিস্তর বোতল ওড়ানোর পর সে নির্ঘাত ববকে শাপমন্যি করে বিদায় নিয়েছে।
হাতের দস্তানাটা সামান্য টেনে নিয়ে বেশ একটু কসরত করেই বুড়োটার মৃতদেহ বস্তাটার ভেতর থেকে বের করে আনল বব। নিগ্রোটার ওভারকোটের ভেতরটা এখনো গরম। কোটখানা বেশ উঁচু মানেরই বলতে হয়। অন্তত সাধারণ গরীব নিগ্রোরা এগুলো পড়ে না। বব একটু পরখ করে দেখল।
সময় নষ্ট করলে চলবে না, বলা যায় না টহলদার পুলিশ চলে আসতে পারে। সে যখন ঠিকই করে ফেলেছে জর্জটাউন থেকে পাকাপাকি বিদায় নেবে তখন ঝুটঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কি? তাছাড়া বেশীক্ষণ এই ঠান্ডায় থাকলে সে নিজেও কাবু হতে পারে।
বব লাশটাকে টেনে হিঁচড়ে দাঁড় করাল। তারপর কোনোরকমে পিঠে চাপিয়ে এক পা দুপা করে জঞ্জাল ফেলার বিরাট চৌকো ক্রেটটার দিকে এগোতে লাগল।
—‘এই তাহলে ব্যাপার, বব উইলিস, হলফ করে বলাই যায় তুমি আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মোটেই এই পরিস্থিতির কথা ভাবোনি।’
নিজের মনেই হেসে উঠল বব। গোটা ব্যাপারটার এরকম পরিণতি হওয়াতে সে নিজে যারপরনাই অবাক। সে ভেবেছিল নিগ্রোটার সাথে রাত্রে জমিয়ে খানাপিনা করবে।
দেহটা ভীষণ ভারী, এবং ক্রেটটা বেশ উঁচু। সাধারণত সাফাইওয়ালারা বড়বড় ভারী যন্ত্রপাতিবোঝাই গাড়ি নিয়ে এসে ক্রেট সমেত তুলে নিয়ে যায়। ছোট ছেলেমেয়েরা যাতে ভুল করে ওর মধ্যে না গিয়ে পড়ে সেজন্য অমন উঁচু করা হয়েছে। সুতরাং, লাশটা ক্রেটটার ভেতর ছুঁড়ে ফেলতে হলে ববকে রীতিমতো কসরত করতে হবে। এবং যেহেতু সে জর্জটাউনের একজন সভ্য নাগরিক তাই সে যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলতে পারে না। বার দুই চেষ্টা করার পর বব হাঁপিয়ে পড়ল।
—‘যীশুর দিব্যি! লোকটা এত ভারী কেন?’
কালো ওভারকোটটা এখনও বুড়োর গায়ে। বরফ কুচি পড়ে দিব্যি একটা নকশা তৈরী হয়েছে। দামী কোট। যেসব বড়লোকেরা জর্জটাউনের উত্তরে বাস করে তারা সাধারণতঃ এই জাতীয় কোট পছন্দ করে। হয়তো ওদেরই কারোর থেকে চুরি করেছে এই হতভাগা।
—‘আহা, আমি কি ভুল করছি, আমি তো এই কোটটা স্বচ্ছন্দে খুলে নিতে পারি।’
বব ঝুঁকে পড়ে ওভারকোটটা নিরীক্ষণ করতে লাগল।
—‘যদি বেঁচে থাকতে তাহলে তুমি অবশ্যই বলতে এটা তুমি কোথা থেকে পেয়েছ? হয়তো এটা আমি তোমার কাছ থেকে কিনেই নিতাম। তবে দু’ডলারের বেশি তুমি দাম পেতে না।’
বব বসে পড়ে ওভারকোটের বোতামগুলো খুলতে লাগল।
—‘এখন যেহেতু তুমি মারা গেছ, তাই তোমাকে টাকাপয়সার কথা বলে বিব্রত করতে চাইছি না। আর তাছাড়া স্বর্গ বা নরকে যেরকম ব্যবস্থা শুনেছি তাতে টাকাপয়সা নিয়ে গিয়ে বিশেষ লাভ কিছু হত না।’
ঠান্ডায় ববের আঙুলগুলো জমে আসছে। দ্রুত বোতামগুলো খোলার পর সে কোনোরকমে ওভারকোটটা উদ্ধার করল।
‘এইবার, মনে হচ্ছে আমি তোমাকে ঠিক জায়গায় নিয়ে যেতে পারব। কাল সকালে সাফাইওয়ালারা বাকিটা বুঝে নেবে’, নিগ্রোটার দিকে চেয়ে বিড়বিড় করল বব। ঠান্ডা তার শীতের পোষাক ভেদ করে হাড় অবধি পৌঁছে যাচ্ছে। নিজের প্যান্টের পকেট থেকে সে একটা ছোট্ট বোতল বার করল। এটা মিসেস হিগিন্সের অবদান। প্রবল শৈত্যে বব বিপদে পড়তে পারে ভেবে তিনি সরাইখানার গুদামঘর থেকে এটি সরিয়েছেন। বব একঢোঁক গলায় ঢেলে মিসেস হিগিন্সের উদ্দেশ্যে ধন্যবাদ জানাল।
—‘তুমি যদি আরো একটা রাত কাটাতে পারতে, তাহলে তোমাকে আমি চিংড়ীমাছের ব্যবসার অংশীদার করতে পারতুম। তবে তোমার কপাল মন্দ এটা বলতেই হয়।’
বব আর এক ঢোঁক খেল। লাশটা বরফের উপর শোয়ানো। ধীরে ধীরে বরফকুচিতে শরীরটা ঢেকে যাচ্ছে। ওভারকোটটা একপাশে রাখা।
—‘আমি চেয়েছিলাম তোমার উপকার করতে, তবে তোমার তো ব্যাপারটা মনপসন্দ হল না। তবে কি জান এই মুহূর্তে তোমার কবরের জায়গা হিসেবে এইখানটাই আমার পছন্দ। আর তোমার ওভারকোটটা আমি অবশ্যই নিয়ে নেব, কারণ তোমার খাওয়ার খরচা বাবদ মিসেস হিগিন্সের কাছে আমার কিছু ধার হয়েছে।’
তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে হবে। গলায় আর এক ঢোঁক ঢেলে বব বোতলটাকে পকেটে পুরলো। তারপর বুড়োর মৃতদেহটা কোনোরকমে তুলে ধরে সর্বশক্তি নিয়ে সে ছুঁড়ে দিল ক্রেটটার ভিতরে। এই বার তার প্রচেষ্টা সার্থক করে লাশটা ক্রেটটার ভিতরে গিয়ে পড়ল। হাল্কা নরম একটা আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে শিস্ দিয়ে উঠল বব। আপদ গেছে। চারিদিক একবার দেখে নিল সে। নাহ্, সিটিহল অ্যালির ভিতর জঞ্জালের স্তূপের কাছে এই ঘটনা লক্ষ্য করার মতো কেউ নেই।
এবার যত দ্রুত সম্ভব ঘরে ফিরতে হবে। মুখ ফিরিয়ে হাঁটা শুরু করতেই ববের মনে একটু খটকা লাগল। কাজটা কি ঠিক হল? ওভারকোটটা খুলে নেওয়াটা বড় নিষ্ঠুর হল বোধহয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে একটা নিগ্রো বুড়োটার মৃতদেহ ঠিক কতখানি সম্মানের যোগ্য। যদিও একজন প্রকৃত ক্যাথলিক হিসেবে তার উচিত ছিল ওর সৎকার করা কিন্তু পাদ্রী সাহেব যে বলেন ওদের মধ্যে শয়তান বাস করে, নরকের আগুনে ক্রমাগত পোড়ে বলেই ওদের গায়ের চামড়ার রঙ কালো। সেক্ষেত্রে...
—‘হা ঈশ্বর!’
মুহূর্তের দ্বন্দ্ব কাটিয়ে বব শপথ নিল তার এই কৃতকর্মের কথা সে কাউকে জানাবে না। কেউ জানবে না বব উইলিস, জর্জটাউন কোলিয়ারীর শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা, একটা মৃত নিগ্রো বুড়োর দেহ থেকে ওভারকোট খুলে নিয়েছিল।
‘কি অদ্ভুত রাত্রি’, স্বগতোক্তি করল বব, তারপর রাস্তা থেকে ওভারকোটটা তুলে নিয়ে গায়ে চড়িয়ে সে হাঁটা দিল সরাইখানার উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে তার মনে হল জর্জটাউন আর তাকে কোনো বিস্ময় উপহার দিতে পারবে না, এ শহর এখন তার কাছে বাতিল আবর্জনার মতোই ফেলনা। শূন্য থেকে নেমে আসা রাশি রাশি তুলোর মত পেঁজা বরফের দিকে তাকিয়ে সে মনস্থির করে ফেলল হ্যামন্ডের সামুদ্রিক উষ্ণতা তাকে পেতেই হবে। মাথা নিচু করে সে সিটিহল অ্যালির নোংরা বাঁচিয়ে দ্রুতপায়ে হাঁটতে লাগল, তারপর একসময় মিলিয়ে গেল গ্যাসবাতির আধো আলোয় ঢেকে রাখা ক্রাম্যার্স স্ট্রীটের ধোঁয়াশার ভিতর।
আমাদের গল্প এইখানে, সিটি হল অ্যালিতে বব উইলিসের অপসৃয়মান চেহারার প্রেক্ষাপটেই সমাপ্ত হচ্ছে তবে শেষকথা হিসেবে একটা তুচ্ছ ব্যাপার বলা যেতেই পারে যেটা আমাদের গল্পের নায়ক এখনো জানেনা। সেটা হল, যে ওভারকোট সে এইমাত্র গায়ে চড়িয়েছে তার ডানপকেটে একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো ও পেন্সিল রয়েছে। যাতে লেখা আছে, ‘আমার মৃত্যুর পর ওভারকোটখানি যেন মিঃ বব উইলিসকে দিয়ে দেওয়া হয়, মাংস ও মদের দাম বাবদ, ধন্যবাদ।’
এই কথাগুলো বলার কারণ আমাদের গল্পের নায়ক বব উইলিস এই সমস্ত স্বাভাবিক সুখী ভাবনা ছেড়ে একটি অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল। কাজটি যে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কঠিন ও পরিশ্রমসাধ্য তাতে তার কোনো সন্দেহ ছিল না। তাই নিগ্রো বুড়োর মৃতদেহটা বস্তাবন্দী করে টেনে হিঁচড়ে রাস্তার শেষে বড় জঞ্জালের স্তূপের সামনে এনে ফেলে সে পরিতৃপ্তির হাসি হাসল।
এই অবস্থায় তাকে কেউ দেখেনি। দেখা সম্ভবও ছিল না, কারণ জর্জটাউনের লোকেরা এত বোকাও নয় যে ঘরের ভেতর নিশ্চিন্ত আগুনের উত্তাপ ছেড়ে বরফঠান্ডা সিটিহল অ্যালির এককোণে কি হচ্ছে তার খোঁজ নেবে। হাঁফাতে হাঁফাতে বব নিজের অদৃষ্টকে গালমন্দ করছিল।
কত রাত হবে এখন? রাস্তায় জনপ্রাণী নেই। নিঝুম জর্জটাউনের অলিতে গলিতে শুধু হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ। রাত্রের নিজস্ব আলোয় দেখা যাচ্ছে বাড়ীঘরের জানালা দরজা বরফে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। হয়তো কাল সকালে রেডিওতে ওরা ঘোষণা করবে মরসুমের সবচেয়ে বেশী তুষারপাত গতকালই হয়েছে। বব লক্ষ্য করল, বরফের উপর বস্তাটাকে টেনে হিঁচড়ে আনার দাগ তৈরী হয়েছে। এতে অবশ্য সে ঘাবড়াল না কারণ সে জানে এই দাগ মুছে যেতে বেশী সময় লাগবে না।
বস্তার মুখ খুলে সে একবার দেখল বুড়োর মুখটা। মাংসের টিনের কৌটোয় যেরকম হাস্যকর গবাদি পশুর ছবি দেওয়া থাকে ঠিক সেরকম। চোখ দু’টো এখনো খোলা। ববের মনে একটু করুণার উদ্রেক হওয়াতে সে হাত দিয়ে বুড়োটার চোখ দু’টো বুজিয়ে দিল।
—‘ঈশ্বর করুণাময়, ও আজ রাতেই মারা যেত। আমি শপথ করে বলতে পারি আমার কোনো ভূমিকা ছিল না এতে।’
স্বগতোক্তি করল বব। হঠাৎ মনে এলো বেনসনের কথা। সে নিশ্চয়ই আজ চেস্টারের পাবে ববের অপেক্ষায় ছিল। বিস্তর বোতল ওড়ানোর পর সে নির্ঘাত ববকে শাপমন্যি করে বিদায় নিয়েছে।
হাতের দস্তানাটা সামান্য টেনে নিয়ে বেশ একটু কসরত করেই বুড়োটার মৃতদেহ বস্তাটার ভেতর থেকে বের করে আনল বব। নিগ্রোটার ওভারকোটের ভেতরটা এখনো গরম। কোটখানা বেশ উঁচু মানেরই বলতে হয়। অন্তত সাধারণ গরীব নিগ্রোরা এগুলো পড়ে না। বব একটু পরখ করে দেখল।
সময় নষ্ট করলে চলবে না, বলা যায় না টহলদার পুলিশ চলে আসতে পারে। সে যখন ঠিকই করে ফেলেছে জর্জটাউন থেকে পাকাপাকি বিদায় নেবে তখন ঝুটঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কি? তাছাড়া বেশীক্ষণ এই ঠান্ডায় থাকলে সে নিজেও কাবু হতে পারে।
বব লাশটাকে টেনে হিঁচড়ে দাঁড় করাল। তারপর কোনোরকমে পিঠে চাপিয়ে এক পা দুপা করে জঞ্জাল ফেলার বিরাট চৌকো ক্রেটটার দিকে এগোতে লাগল।
—‘এই তাহলে ব্যাপার, বব উইলিস, হলফ করে বলাই যায় তুমি আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মোটেই এই পরিস্থিতির কথা ভাবোনি।’
নিজের মনেই হেসে উঠল বব। গোটা ব্যাপারটার এরকম পরিণতি হওয়াতে সে নিজে যারপরনাই অবাক। সে ভেবেছিল নিগ্রোটার সাথে রাত্রে জমিয়ে খানাপিনা করবে।
দেহটা ভীষণ ভারী, এবং ক্রেটটা বেশ উঁচু। সাধারণত সাফাইওয়ালারা বড়বড় ভারী যন্ত্রপাতিবোঝাই গাড়ি নিয়ে এসে ক্রেট সমেত তুলে নিয়ে যায়। ছোট ছেলেমেয়েরা যাতে ভুল করে ওর মধ্যে না গিয়ে পড়ে সেজন্য অমন উঁচু করা হয়েছে। সুতরাং, লাশটা ক্রেটটার ভেতর ছুঁড়ে ফেলতে হলে ববকে রীতিমতো কসরত করতে হবে। এবং যেহেতু সে জর্জটাউনের একজন সভ্য নাগরিক তাই সে যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলতে পারে না। বার দুই চেষ্টা করার পর বব হাঁপিয়ে পড়ল।
—‘যীশুর দিব্যি! লোকটা এত ভারী কেন?’
কালো ওভারকোটটা এখনও বুড়োর গায়ে। বরফ কুচি পড়ে দিব্যি একটা নকশা তৈরী হয়েছে। দামী কোট। যেসব বড়লোকেরা জর্জটাউনের উত্তরে বাস করে তারা সাধারণতঃ এই জাতীয় কোট পছন্দ করে। হয়তো ওদেরই কারোর থেকে চুরি করেছে এই হতভাগা।
—‘আহা, আমি কি ভুল করছি, আমি তো এই কোটটা স্বচ্ছন্দে খুলে নিতে পারি।’
বব ঝুঁকে পড়ে ওভারকোটটা নিরীক্ষণ করতে লাগল।
—‘যদি বেঁচে থাকতে তাহলে তুমি অবশ্যই বলতে এটা তুমি কোথা থেকে পেয়েছ? হয়তো এটা আমি তোমার কাছ থেকে কিনেই নিতাম। তবে দু’ডলারের বেশি তুমি দাম পেতে না।’
বব বসে পড়ে ওভারকোটের বোতামগুলো খুলতে লাগল।
—‘এখন যেহেতু তুমি মারা গেছ, তাই তোমাকে টাকাপয়সার কথা বলে বিব্রত করতে চাইছি না। আর তাছাড়া স্বর্গ বা নরকে যেরকম ব্যবস্থা শুনেছি তাতে টাকাপয়সা নিয়ে গিয়ে বিশেষ লাভ কিছু হত না।’
ঠান্ডায় ববের আঙুলগুলো জমে আসছে। দ্রুত বোতামগুলো খোলার পর সে কোনোরকমে ওভারকোটটা উদ্ধার করল।
‘এইবার, মনে হচ্ছে আমি তোমাকে ঠিক জায়গায় নিয়ে যেতে পারব। কাল সকালে সাফাইওয়ালারা বাকিটা বুঝে নেবে’, নিগ্রোটার দিকে চেয়ে বিড়বিড় করল বব। ঠান্ডা তার শীতের পোষাক ভেদ করে হাড় অবধি পৌঁছে যাচ্ছে। নিজের প্যান্টের পকেট থেকে সে একটা ছোট্ট বোতল বার করল। এটা মিসেস হিগিন্সের অবদান। প্রবল শৈত্যে বব বিপদে পড়তে পারে ভেবে তিনি সরাইখানার গুদামঘর থেকে এটি সরিয়েছেন। বব একঢোঁক গলায় ঢেলে মিসেস হিগিন্সের উদ্দেশ্যে ধন্যবাদ জানাল।
—‘তুমি যদি আরো একটা রাত কাটাতে পারতে, তাহলে তোমাকে আমি চিংড়ীমাছের ব্যবসার অংশীদার করতে পারতুম। তবে তোমার কপাল মন্দ এটা বলতেই হয়।’
বব আর এক ঢোঁক খেল। লাশটা বরফের উপর শোয়ানো। ধীরে ধীরে বরফকুচিতে শরীরটা ঢেকে যাচ্ছে। ওভারকোটটা একপাশে রাখা।
—‘আমি চেয়েছিলাম তোমার উপকার করতে, তবে তোমার তো ব্যাপারটা মনপসন্দ হল না। তবে কি জান এই মুহূর্তে তোমার কবরের জায়গা হিসেবে এইখানটাই আমার পছন্দ। আর তোমার ওভারকোটটা আমি অবশ্যই নিয়ে নেব, কারণ তোমার খাওয়ার খরচা বাবদ মিসেস হিগিন্সের কাছে আমার কিছু ধার হয়েছে।’
তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে হবে। গলায় আর এক ঢোঁক ঢেলে বব বোতলটাকে পকেটে পুরলো। তারপর বুড়োর মৃতদেহটা কোনোরকমে তুলে ধরে সর্বশক্তি নিয়ে সে ছুঁড়ে দিল ক্রেটটার ভিতরে। এই বার তার প্রচেষ্টা সার্থক করে লাশটা ক্রেটটার ভিতরে গিয়ে পড়ল। হাল্কা নরম একটা আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে শিস্ দিয়ে উঠল বব। আপদ গেছে। চারিদিক একবার দেখে নিল সে। নাহ্, সিটিহল অ্যালির ভিতর জঞ্জালের স্তূপের কাছে এই ঘটনা লক্ষ্য করার মতো কেউ নেই।
এবার যত দ্রুত সম্ভব ঘরে ফিরতে হবে। মুখ ফিরিয়ে হাঁটা শুরু করতেই ববের মনে একটু খটকা লাগল। কাজটা কি ঠিক হল? ওভারকোটটা খুলে নেওয়াটা বড় নিষ্ঠুর হল বোধহয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে একটা নিগ্রো বুড়োটার মৃতদেহ ঠিক কতখানি সম্মানের যোগ্য। যদিও একজন প্রকৃত ক্যাথলিক হিসেবে তার উচিত ছিল ওর সৎকার করা কিন্তু পাদ্রী সাহেব যে বলেন ওদের মধ্যে শয়তান বাস করে, নরকের আগুনে ক্রমাগত পোড়ে বলেই ওদের গায়ের চামড়ার রঙ কালো। সেক্ষেত্রে...
—‘হা ঈশ্বর!’
মুহূর্তের দ্বন্দ্ব কাটিয়ে বব শপথ নিল তার এই কৃতকর্মের কথা সে কাউকে জানাবে না। কেউ জানবে না বব উইলিস, জর্জটাউন কোলিয়ারীর শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা, একটা মৃত নিগ্রো বুড়োর দেহ থেকে ওভারকোট খুলে নিয়েছিল।
‘কি অদ্ভুত রাত্রি’, স্বগতোক্তি করল বব, তারপর রাস্তা থেকে ওভারকোটটা তুলে নিয়ে গায়ে চড়িয়ে সে হাঁটা দিল সরাইখানার উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে তার মনে হল জর্জটাউন আর তাকে কোনো বিস্ময় উপহার দিতে পারবে না, এ শহর এখন তার কাছে বাতিল আবর্জনার মতোই ফেলনা। শূন্য থেকে নেমে আসা রাশি রাশি তুলোর মত পেঁজা বরফের দিকে তাকিয়ে সে মনস্থির করে ফেলল হ্যামন্ডের সামুদ্রিক উষ্ণতা তাকে পেতেই হবে। মাথা নিচু করে সে সিটিহল অ্যালির নোংরা বাঁচিয়ে দ্রুতপায়ে হাঁটতে লাগল, তারপর একসময় মিলিয়ে গেল গ্যাসবাতির আধো আলোয় ঢেকে রাখা ক্রাম্যার্স স্ট্রীটের ধোঁয়াশার ভিতর।
আমাদের গল্প এইখানে, সিটি হল অ্যালিতে বব উইলিসের অপসৃয়মান চেহারার প্রেক্ষাপটেই সমাপ্ত হচ্ছে তবে শেষকথা হিসেবে একটা তুচ্ছ ব্যাপার বলা যেতেই পারে যেটা আমাদের গল্পের নায়ক এখনো জানেনা। সেটা হল, যে ওভারকোট সে এইমাত্র গায়ে চড়িয়েছে তার ডানপকেটে একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো ও পেন্সিল রয়েছে। যাতে লেখা আছে, ‘আমার মৃত্যুর পর ওভারকোটখানি যেন মিঃ বব উইলিসকে দিয়ে দেওয়া হয়, মাংস ও মদের দাম বাবদ, ধন্যবাদ।’