ক্র্যামার্স স্ট্রীটের আশপাশ বেশ ঘিঞ্জি। কোলিয়ারীতে যারা কাজ করে তাদের অধিকাংশেরই এখানে বসবাস। বাড়িঘর সব গা ঘেঁষাঘেঁষি। যাদের একটু বেশি পয়সাকড়ি আছে, তাদের বাড়ির সামনে ছোট্ট বাগান। কারও বাড়ির দেওয়ালে ‘বেবিরুথ’ কোম্পানির চকোলেটের বিজ্ঞাপন সাঁটা। বেশ কিছু কালো চামড়ার লোকও এখানে থাকে, যাদের বাড়ির সামনে গেলে স্নোফ্লেক পুডিংএর গন্ধ পাওয়া যায়। এরা ভীষণ নোংরা এবং ঈশ্বরের অসীম দয়া যে এরা কখনো চেস্টারের পাবে ঢোকে না। যে কোনদিন সকাল আটটার সময় কারখানার ভোঁ বাজলে, সার সার জামা জুতো পরে কালো মানুষগুলো মাথা নিচু করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। বব তার দোতলার জানালা থেকে প্রায়শই দেখেছে ওরা পারতপক্ষে কখনো একা একা হাঁটে না। এদের বেশিরভাগই ভবঘুরের দল। কাজ পাওয়ার আশায় দলে দলে এসেছিল এককালে। পুরনো গীর্জার কাছাকাছি সরাই গুলোতে এখনও এরা গাদাগাদি করে থাকে।
দরজা খুলে রাস্তায় বেরোতেই কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপ্টা লাগলো ববের চোখেমুখে। রাস্তায় প্রায় ছ’ইঞ্চি মোটা বরফের স্তর। সারাদেহ ঢাকা সত্ত্বেও বব কেঁপে কেঁপে উঠছিল।
—‘শুভসন্ধ্যা বব, ওঃ কি ঠান্ডাটাই না পড়েছে!’
বিলি জো, সবাই ডাকে লড়াকু জো বলে। দীর্ঘ চেহারা, মজবুত গড়ন, বাপের দর্জির দোকানে আগে কাজ করত। দু’বছর হল কোলিয়ারীতে ঢুকেছে। বব ওকে বিশেষ পছন্দ করে না কারণ বিলি জ্যাজ মিউজিক নিয়ে হুজুগেপনা ভালোবাসে এবং প্রতি রবিবার গীর্জায় গিয়ে সারাক্ষণ মেয়েদের সাথে ঠাট্টাতামাশা চালায়।
—‘শুভসন্ধ্যা জো! চললে কোথায়?’
—‘মিস আইভি রাইট আমাকে ওর বাসায় নেমন্তন্ন করেছে! হেঃ হেঃ।’
বব লক্ষ্য করল, জো এর বাঁহাতে একটা বড়সড় কাপড় ঢাকা বেতের ঝুড়ি। বোঝাই যাচ্ছে সন্ধ্যা উদ্যাপনের জন্য সে বেশ তৈরী হয়েই যাচ্ছে।
—‘আচ্ছা বব্, আমার তাড়া আছে, বুঝতেই তো পারছ। হেঃ হেঃ’
চুলোয় যাও। বব বিরক্ত হয়ে পা চালাল। এইসব লোকেদের থেকে সে সর্বদা দূরে থাকার চেষ্টা করে। পথচলতি উটকো লোকেদের এড়াবার জন্য সে গলিঘুঁজি দিয়ে চলতে লাগল।
সিটিহল অ্যালির ভেতরে ঢুকে সে খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করল, কারণ রাস্তাটা অপেক্ষাকৃত নির্জন। সরু গলিটার দু’ধারে বেশ উঁচু বাড়ি থাকার জন্য বরফও একটু কম। একটু অন্ধকারও বটে। মাঝে মাঝে ফায়ার এস্কেপের সিঁড়ির তলার জানালার ফোকর থেকে বাড়ির ভেতরের আলো এসে পড়েছে। বেশ গা ছমচমে। চলতে চলতে বব জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে বাড়ির ভেতর উঁকি মারতে লাগল।
গলির শেষপ্রান্তে পৌঁছে বব দেখল, যেখানে পুরোনো বাতিল টায়ারগুলো একপাশে জড়ো করে রাখা, তার পাশে একটা অন্ধকার মতোন যেন দলা পাকিয়ে ঘুপচি হয়ে আছে। কৌতূহলী হয়ে কাছে যেতেই বব দেখল কেউ একজন হাত পা জড়োসড়ো করে হাঁটু মুড়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। আপাদমস্তক একখানা কালো কোটে ঢাকা। তার উপর বরফকুচি ছড়িয়ে রয়েছে। দূরের বড়রাস্তা থেকে যেটুকু আলো আসছে তাতে আর কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটা মৃতদেহ নয়, বব স্থির করল, কারণ মাঝে মাঝে গোঙানির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
একটা শিস দিল বব, ‘এইও, কে তুমি?’
কোনো উত্তর নেই।
বব এবার একটু ঠেলা দিল, ‘এইও, শুনতে পাচ্ছ?’
—‘দূর হ! শয়তান।’
বাব্বা, মেজাজ আছে বটে। বব একটু আমোদ পেয়ে ধীরে ধীরে ওর মুখের ওপর থেকে কাপড়টা সরাতেই দেখতে পেল, মাথায় সাদা চুল এক বুড়ো, মুখে অসংখ্য বলিরেখা, ঠিক যেমনটা তাদের শিফ্ট অপারেটরের মুখে রয়েছে, ঘোলাটে দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কালো মুখে চোখ দু’টো কোটরে ঢোকা, সাদাটে দাড়ি, হঠাৎ দেখলে মনে হয় কতদিন না খেতে পেয়ে রয়েছে। মুখের গড়নে অনেকটা ককেশীয় ছাপ স্পষ্ট।
—‘এমন শীতের সন্ধে কাটানোর উপযুক্ত স্থানই বটে, কি বল?’
বুড়ো কোনো জবাব দিল না, আপনমনে চোখ বুজে কি সব বিড়বিড় করছে।
একটু উসখুশ করল বব। লোকটা এমনভাবে এখানে বসে আছে কেন? এখানে শীতে জমে যেতে কতক্ষণ। অবশ্য ওর গায়ের কোটটা যদিও বেশ মোটা। পা দিয়ে কোটটা একটু উঁচু করে তুলে বুড়োর পায়ের কাছটা দেখল বব। যুদ্ধের পর সেনারা যেসব ছেঁড়া বুটজুতো বিক্রি করেছিল সেইরকমই একজোড়া বুটজুতো। বুড়ো ফের নড়ে উঠে একটু গোঙাল।
—‘এর থেকে নিজের ঘরে বসে আফিম খেলেই তো পারো। থাকো কোথায়?’
বুড়ো একথারও কোনো জবাব দিল না। শুধু তাই নয়, পরবর্তী পাঁচমিনিট ধরে ববের কোনো প্রশ্নেরই কোনো উত্তর দিল না। বাধ্য হয়ে বব স্থির করল বুড়ো হয়তো কানে খাটো অথবা উন্মাদ নয়তো সেইসব বেয়াক্কেলে লোকগুলোর একটা যাদের একমাত্র কাজ হল ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে পুরনো চিঠিপত্র পড়া।
বিরক্ত হয়ে বব স্থির করল এই ব্যাপারটা খোদ ঈশ্বরের উপরেই ছেড়ে দেওয়া যাক। পাদ্রী সাহেব যেমন বলেন, মুশকিলে পড়লে বাইবেলে বর্ণিত ওই ভদ্রলোকটিই তোমাকে পথ দেখাবেন।
এমন সময় গলিতে আরও একটি মানুষের আবির্ভাব ঘটলো। যার লাঠি এবং টুপি দেখে ববের চিনতে কোনো অসুবিধা হলো না। সার্জেন্ট র্যামোস। হাতে অর্দ্ধেক শেষ হওয়া বোতল। ববকে দেখে সে ধীর পায়ে এগিয়ে এল।
—‘আরে, আমাদের বব উইলিস যে। কী ব্যাপার বব, এই মারাত্মক শীতে সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়েছ নাকি?’
বব কোনো কথা না বলে ইশারায় বুড়োকে দেখাল।
সার্জেন্ট র্যামোস একটু ঝুঁকে পড়ে বুড়োটাকে দেখল। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘না হে, এ সেই লুটেরা বেঞ্জামিন রাইডার নয়। তুমি যদি ইনামের কথা ভেবে থাক, তাহলে বলতেই হচ্ছে তোমার কপাল মন্দ।’
—‘লোকটা কে?’
—‘কি করে বলব হে, আগে দেখিনি বলেই তো মনে হচ্ছে। হয়তো কাজের সন্ধানে এসেছিলো। ভবঘুরেও হতে পারে, তবে কোটটা খাসা বাগিয়েছে।’
—‘তোমার কি ওকে থানায় নিয়ে যাওয়া উচিত নয়? এখানে থাকলে তো শীতে মারা পড়বে।’
সার্জেন্ট র্যামোস বেশ বিরক্ত হল একথা শুনে। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘শোনো বব, তোমাকে আগে বলিনি, আমার এখন ডিউটি দেওয়ার কথাই নয়। নেহাত চেস্টারের পাবে গলা ভেজাতে এসেছিলাম বলেই না। আর তাছাড়া আমার বউ কত ভালো লেটুস পাতার স্যুপ বানায় তা জান। সেসব ছেড়ে এখন থানায়...তা, তোমার এত দরদ যখন নিজের সাথে নিয়ে গেলেই তো পারো। নতুবা শেরিফকে খবর দাও।’
বব কোনো কথা না বলে বুড়োটার দিকে চেয়ে রইল। রাস্তার ধারের গ্যাসবাতি গুলো জ্বলে উঠেছে। সেই আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে লোকটা ঠান্ডায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। ওর দিকে চেয়ে ববের করুণা হল। হয়তো ওর কেউ নেই, হয়তো ও আজ ডিনার টেবিলে বসে রুটিটা নোনতা বলেছিল, তাই হয়তো ওর বৌ ওকে বার করে দিয়েছে। হয়তো ও জর্জটাউনের রেলইয়ার্ডে কোনো কাজ চাইতে এসেছিলো, ওর বেঁটে বেঁটে হাত পা দেখে ওরা তাড়িয়ে দিয়েছে। ববের মনে হল এই সেই সময় যখন ঈশ্বর পরীক্ষা নেন মানুষের মানবিক বোধের। ঝট করে বব স্থির করল লোকটিকে সে বাড়ি নিয়ে যাবে।
পরিকল্পনাটা র্যামোসকে খুলে বলতেই সে একচোট হেসে বলল, ‘পাদ্রী সাহেব তোমার মাথা খেয়েছেন দেখছি। শোনো, লোকটা এমনিই মারা যাবে, রেডিওর খবর শুনেছ, টানা দু’দিন এরকম তুষারপাত চলবে। বুড়োর মরার ইচ্ছে হয়েছে, বুঝলে। এক কাজ কর, ওকে ওই যে বড় জঞ্জালের ঢিবিটা দেখছ, ওখানেই ছুঁড়ে ফেলে দাও না কেন। ব্যাপারটা কাল সকালের সাফাইওয়ালাদের ওপর দিয়েই যাবে।’
প্রস্তাবটা ববের মনঃপুত হল না। এমনও তো হতে পারে যে বুড়োটা হয়তো পথ হারিয়েছে, হয়তো ওর অন্য কোথাও যাওয়ার কথা। কোনো বাড়ি বা সরাইতে জায়গা না পেয়ে শেষে এখানে এসে বসে রয়েছে। ওর দরকার পর্যাপ্ত খাবার এবং ঘুম।
—‘বেশ নিয়ে যেতে পারো, তবে ফ্যাসাদে পড়তে পারো কিন্তু।’
সে যাই হোক, বব তবু একবার চেষ্টা করে দেখবে বৈকি। র্যামোসকে সে অনুরোধ করল তাকে একটু সাহায্য করার জন্য।
—‘মন্দ বলনি। মাঝে মাঝে আইনরক্ষক হিসেবে আমারও যে কিছু করনীয় আছে তা মনে করা ভাল। তাছাড়া একটু গা গরমও হবে।’
দু’জনে মিলে বুড়োর হাত পা ধরে তুলে নিয়ে চলতে লাগল। গলিটা একেই বেশ সরু, তাছাড়া যত্রতত্র টিন ক্যান আর জঞ্জাল আবর্জনায় ভর্তি, তাই ওদের চলতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল।
—‘তোমার কি মনে হয় বব? আমার কথাও ওপরওয়ালার ভাবা উচিত, নয় কি?’
—‘কেন বলতো?’
‘এই যে, তোমার মহৎ কাজে তোমাকে সাহায্য করছি, প্রতিদানে ঈশ্বরের আমাকেও কিছু দেওয়া উচিত। যেমন ধর ক্রিসমাস গিফ্ট হিসেবে একটা পুরোনো কনিয়াকের বোতল’, র্যামোস হাঁফাতে লাগল।
—‘তোমার রুচি আছে বটে, ওপরমহলে মেলামেশা কর নাকি?’
র্যামোস ঘাড় নাড়ল। সে বড়লোকদের দু’চক্ষে দেখতে পারে না, বিশেষ করে যারা র্যাকুন কোট পরে এবং দর্জির কাছে ট্রাউজারের নিচের মাপ চব্বিশ ইঞ্চি দেয়। তার দৃঢ় বিশ্বাস ভলস্টেড আইন চালু করার পিছনে এই লোকগুলোরই হাত রয়েছে। এদের জন্যই সিগারেটের প্যাকেট তাকে দশ সেন্ট দিয়ে কিনতে হয় এবং সুবিধা পেলে এই ধরনের বখাটেদের সে মজা দেখাবে।
সরাইখানার সামনে পৌঁছে বব শুনতে পেল হিগিন্সের পিয়ানোর আওয়াজ। তার মানে মজলিশ এখনো শেষ হয়নি। সে র্যামোসকে ধন্যবাদ জানাল এবং এটাও জানাতে ভুলল না যে বব তার হয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবে। লোকজনের গলার আওয়াজ পেয়ে হিগিন্স কৌতূহলী হয়ে পিয়ানো ছেড়ে উঠে এলো।
—‘বাহ্, বেশ তো বব। শোনো, আমার সরাইখানা ট্রেভরের শুয়োর খোঁয়াড় পাওনি।’
—‘একটা রাতের ব্যাপার হিগিন্স, ও আমার ঘরেই না হয় থাকবে, শীতে কষ্ট পাচ্ছিল, তাই তোমার এখানে নিয়ে এলাম। কিছু খাবার পেতে পারি মিসেস হিগিন্স? বলতেই হচ্ছে, আপনার ক্লাউশ হ্যাটটা লেডি ব্রুকসের মতো।’
মিসেস হিগিন্স উল বুনছিলেন, ববের কথায় চেয়ার ছেড়ে কিচেনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতেই হিগিন্স চোখের ইশারা করল।
—‘না হে, হবে না। আজ রাতের মতো সব শেষ। ঠিক আছে, নিগ্রো লোকটাকে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে পার তবে আমি ভেবে অবাক হচ্ছি, তুমি নিজেই ওর জন্য খাবার কিনে আনছ না কেন?’
মৃদু স্বরে শাপশাপান্ত করল বব। ঠিক আছে সে না হয় নিজেই খাবারদাবারের বন্দোবস্ত করবে। আপাতত বুড়োটাকে নিজের ঘরে নিয়ে যাওয়া যাক।
দরজা খুলে রাস্তায় বেরোতেই কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপ্টা লাগলো ববের চোখেমুখে। রাস্তায় প্রায় ছ’ইঞ্চি মোটা বরফের স্তর। সারাদেহ ঢাকা সত্ত্বেও বব কেঁপে কেঁপে উঠছিল।
—‘শুভসন্ধ্যা বব, ওঃ কি ঠান্ডাটাই না পড়েছে!’
বিলি জো, সবাই ডাকে লড়াকু জো বলে। দীর্ঘ চেহারা, মজবুত গড়ন, বাপের দর্জির দোকানে আগে কাজ করত। দু’বছর হল কোলিয়ারীতে ঢুকেছে। বব ওকে বিশেষ পছন্দ করে না কারণ বিলি জ্যাজ মিউজিক নিয়ে হুজুগেপনা ভালোবাসে এবং প্রতি রবিবার গীর্জায় গিয়ে সারাক্ষণ মেয়েদের সাথে ঠাট্টাতামাশা চালায়।
—‘শুভসন্ধ্যা জো! চললে কোথায়?’
—‘মিস আইভি রাইট আমাকে ওর বাসায় নেমন্তন্ন করেছে! হেঃ হেঃ।’
বব লক্ষ্য করল, জো এর বাঁহাতে একটা বড়সড় কাপড় ঢাকা বেতের ঝুড়ি। বোঝাই যাচ্ছে সন্ধ্যা উদ্যাপনের জন্য সে বেশ তৈরী হয়েই যাচ্ছে।
—‘আচ্ছা বব্, আমার তাড়া আছে, বুঝতেই তো পারছ। হেঃ হেঃ’
চুলোয় যাও। বব বিরক্ত হয়ে পা চালাল। এইসব লোকেদের থেকে সে সর্বদা দূরে থাকার চেষ্টা করে। পথচলতি উটকো লোকেদের এড়াবার জন্য সে গলিঘুঁজি দিয়ে চলতে লাগল।
সিটিহল অ্যালির ভেতরে ঢুকে সে খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করল, কারণ রাস্তাটা অপেক্ষাকৃত নির্জন। সরু গলিটার দু’ধারে বেশ উঁচু বাড়ি থাকার জন্য বরফও একটু কম। একটু অন্ধকারও বটে। মাঝে মাঝে ফায়ার এস্কেপের সিঁড়ির তলার জানালার ফোকর থেকে বাড়ির ভেতরের আলো এসে পড়েছে। বেশ গা ছমচমে। চলতে চলতে বব জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে বাড়ির ভেতর উঁকি মারতে লাগল।
গলির শেষপ্রান্তে পৌঁছে বব দেখল, যেখানে পুরোনো বাতিল টায়ারগুলো একপাশে জড়ো করে রাখা, তার পাশে একটা অন্ধকার মতোন যেন দলা পাকিয়ে ঘুপচি হয়ে আছে। কৌতূহলী হয়ে কাছে যেতেই বব দেখল কেউ একজন হাত পা জড়োসড়ো করে হাঁটু মুড়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। আপাদমস্তক একখানা কালো কোটে ঢাকা। তার উপর বরফকুচি ছড়িয়ে রয়েছে। দূরের বড়রাস্তা থেকে যেটুকু আলো আসছে তাতে আর কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটা মৃতদেহ নয়, বব স্থির করল, কারণ মাঝে মাঝে গোঙানির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
একটা শিস দিল বব, ‘এইও, কে তুমি?’
কোনো উত্তর নেই।
বব এবার একটু ঠেলা দিল, ‘এইও, শুনতে পাচ্ছ?’
—‘দূর হ! শয়তান।’
বাব্বা, মেজাজ আছে বটে। বব একটু আমোদ পেয়ে ধীরে ধীরে ওর মুখের ওপর থেকে কাপড়টা সরাতেই দেখতে পেল, মাথায় সাদা চুল এক বুড়ো, মুখে অসংখ্য বলিরেখা, ঠিক যেমনটা তাদের শিফ্ট অপারেটরের মুখে রয়েছে, ঘোলাটে দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কালো মুখে চোখ দু’টো কোটরে ঢোকা, সাদাটে দাড়ি, হঠাৎ দেখলে মনে হয় কতদিন না খেতে পেয়ে রয়েছে। মুখের গড়নে অনেকটা ককেশীয় ছাপ স্পষ্ট।
—‘এমন শীতের সন্ধে কাটানোর উপযুক্ত স্থানই বটে, কি বল?’
বুড়ো কোনো জবাব দিল না, আপনমনে চোখ বুজে কি সব বিড়বিড় করছে।
একটু উসখুশ করল বব। লোকটা এমনভাবে এখানে বসে আছে কেন? এখানে শীতে জমে যেতে কতক্ষণ। অবশ্য ওর গায়ের কোটটা যদিও বেশ মোটা। পা দিয়ে কোটটা একটু উঁচু করে তুলে বুড়োর পায়ের কাছটা দেখল বব। যুদ্ধের পর সেনারা যেসব ছেঁড়া বুটজুতো বিক্রি করেছিল সেইরকমই একজোড়া বুটজুতো। বুড়ো ফের নড়ে উঠে একটু গোঙাল।
—‘এর থেকে নিজের ঘরে বসে আফিম খেলেই তো পারো। থাকো কোথায়?’
বুড়ো একথারও কোনো জবাব দিল না। শুধু তাই নয়, পরবর্তী পাঁচমিনিট ধরে ববের কোনো প্রশ্নেরই কোনো উত্তর দিল না। বাধ্য হয়ে বব স্থির করল বুড়ো হয়তো কানে খাটো অথবা উন্মাদ নয়তো সেইসব বেয়াক্কেলে লোকগুলোর একটা যাদের একমাত্র কাজ হল ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে পুরনো চিঠিপত্র পড়া।
বিরক্ত হয়ে বব স্থির করল এই ব্যাপারটা খোদ ঈশ্বরের উপরেই ছেড়ে দেওয়া যাক। পাদ্রী সাহেব যেমন বলেন, মুশকিলে পড়লে বাইবেলে বর্ণিত ওই ভদ্রলোকটিই তোমাকে পথ দেখাবেন।
এমন সময় গলিতে আরও একটি মানুষের আবির্ভাব ঘটলো। যার লাঠি এবং টুপি দেখে ববের চিনতে কোনো অসুবিধা হলো না। সার্জেন্ট র্যামোস। হাতে অর্দ্ধেক শেষ হওয়া বোতল। ববকে দেখে সে ধীর পায়ে এগিয়ে এল।
—‘আরে, আমাদের বব উইলিস যে। কী ব্যাপার বব, এই মারাত্মক শীতে সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়েছ নাকি?’
বব কোনো কথা না বলে ইশারায় বুড়োকে দেখাল।
সার্জেন্ট র্যামোস একটু ঝুঁকে পড়ে বুড়োটাকে দেখল। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘না হে, এ সেই লুটেরা বেঞ্জামিন রাইডার নয়। তুমি যদি ইনামের কথা ভেবে থাক, তাহলে বলতেই হচ্ছে তোমার কপাল মন্দ।’
—‘লোকটা কে?’
—‘কি করে বলব হে, আগে দেখিনি বলেই তো মনে হচ্ছে। হয়তো কাজের সন্ধানে এসেছিলো। ভবঘুরেও হতে পারে, তবে কোটটা খাসা বাগিয়েছে।’
—‘তোমার কি ওকে থানায় নিয়ে যাওয়া উচিত নয়? এখানে থাকলে তো শীতে মারা পড়বে।’
সার্জেন্ট র্যামোস বেশ বিরক্ত হল একথা শুনে। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘শোনো বব, তোমাকে আগে বলিনি, আমার এখন ডিউটি দেওয়ার কথাই নয়। নেহাত চেস্টারের পাবে গলা ভেজাতে এসেছিলাম বলেই না। আর তাছাড়া আমার বউ কত ভালো লেটুস পাতার স্যুপ বানায় তা জান। সেসব ছেড়ে এখন থানায়...তা, তোমার এত দরদ যখন নিজের সাথে নিয়ে গেলেই তো পারো। নতুবা শেরিফকে খবর দাও।’
বব কোনো কথা না বলে বুড়োটার দিকে চেয়ে রইল। রাস্তার ধারের গ্যাসবাতি গুলো জ্বলে উঠেছে। সেই আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে লোকটা ঠান্ডায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। ওর দিকে চেয়ে ববের করুণা হল। হয়তো ওর কেউ নেই, হয়তো ও আজ ডিনার টেবিলে বসে রুটিটা নোনতা বলেছিল, তাই হয়তো ওর বৌ ওকে বার করে দিয়েছে। হয়তো ও জর্জটাউনের রেলইয়ার্ডে কোনো কাজ চাইতে এসেছিলো, ওর বেঁটে বেঁটে হাত পা দেখে ওরা তাড়িয়ে দিয়েছে। ববের মনে হল এই সেই সময় যখন ঈশ্বর পরীক্ষা নেন মানুষের মানবিক বোধের। ঝট করে বব স্থির করল লোকটিকে সে বাড়ি নিয়ে যাবে।
পরিকল্পনাটা র্যামোসকে খুলে বলতেই সে একচোট হেসে বলল, ‘পাদ্রী সাহেব তোমার মাথা খেয়েছেন দেখছি। শোনো, লোকটা এমনিই মারা যাবে, রেডিওর খবর শুনেছ, টানা দু’দিন এরকম তুষারপাত চলবে। বুড়োর মরার ইচ্ছে হয়েছে, বুঝলে। এক কাজ কর, ওকে ওই যে বড় জঞ্জালের ঢিবিটা দেখছ, ওখানেই ছুঁড়ে ফেলে দাও না কেন। ব্যাপারটা কাল সকালের সাফাইওয়ালাদের ওপর দিয়েই যাবে।’
প্রস্তাবটা ববের মনঃপুত হল না। এমনও তো হতে পারে যে বুড়োটা হয়তো পথ হারিয়েছে, হয়তো ওর অন্য কোথাও যাওয়ার কথা। কোনো বাড়ি বা সরাইতে জায়গা না পেয়ে শেষে এখানে এসে বসে রয়েছে। ওর দরকার পর্যাপ্ত খাবার এবং ঘুম।
—‘বেশ নিয়ে যেতে পারো, তবে ফ্যাসাদে পড়তে পারো কিন্তু।’
সে যাই হোক, বব তবু একবার চেষ্টা করে দেখবে বৈকি। র্যামোসকে সে অনুরোধ করল তাকে একটু সাহায্য করার জন্য।
—‘মন্দ বলনি। মাঝে মাঝে আইনরক্ষক হিসেবে আমারও যে কিছু করনীয় আছে তা মনে করা ভাল। তাছাড়া একটু গা গরমও হবে।’
দু’জনে মিলে বুড়োর হাত পা ধরে তুলে নিয়ে চলতে লাগল। গলিটা একেই বেশ সরু, তাছাড়া যত্রতত্র টিন ক্যান আর জঞ্জাল আবর্জনায় ভর্তি, তাই ওদের চলতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল।
—‘তোমার কি মনে হয় বব? আমার কথাও ওপরওয়ালার ভাবা উচিত, নয় কি?’
—‘কেন বলতো?’
‘এই যে, তোমার মহৎ কাজে তোমাকে সাহায্য করছি, প্রতিদানে ঈশ্বরের আমাকেও কিছু দেওয়া উচিত। যেমন ধর ক্রিসমাস গিফ্ট হিসেবে একটা পুরোনো কনিয়াকের বোতল’, র্যামোস হাঁফাতে লাগল।
—‘তোমার রুচি আছে বটে, ওপরমহলে মেলামেশা কর নাকি?’
র্যামোস ঘাড় নাড়ল। সে বড়লোকদের দু’চক্ষে দেখতে পারে না, বিশেষ করে যারা র্যাকুন কোট পরে এবং দর্জির কাছে ট্রাউজারের নিচের মাপ চব্বিশ ইঞ্চি দেয়। তার দৃঢ় বিশ্বাস ভলস্টেড আইন চালু করার পিছনে এই লোকগুলোরই হাত রয়েছে। এদের জন্যই সিগারেটের প্যাকেট তাকে দশ সেন্ট দিয়ে কিনতে হয় এবং সুবিধা পেলে এই ধরনের বখাটেদের সে মজা দেখাবে।
সরাইখানার সামনে পৌঁছে বব শুনতে পেল হিগিন্সের পিয়ানোর আওয়াজ। তার মানে মজলিশ এখনো শেষ হয়নি। সে র্যামোসকে ধন্যবাদ জানাল এবং এটাও জানাতে ভুলল না যে বব তার হয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবে। লোকজনের গলার আওয়াজ পেয়ে হিগিন্স কৌতূহলী হয়ে পিয়ানো ছেড়ে উঠে এলো।
—‘বাহ্, বেশ তো বব। শোনো, আমার সরাইখানা ট্রেভরের শুয়োর খোঁয়াড় পাওনি।’
—‘একটা রাতের ব্যাপার হিগিন্স, ও আমার ঘরেই না হয় থাকবে, শীতে কষ্ট পাচ্ছিল, তাই তোমার এখানে নিয়ে এলাম। কিছু খাবার পেতে পারি মিসেস হিগিন্স? বলতেই হচ্ছে, আপনার ক্লাউশ হ্যাটটা লেডি ব্রুকসের মতো।’
মিসেস হিগিন্স উল বুনছিলেন, ববের কথায় চেয়ার ছেড়ে কিচেনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতেই হিগিন্স চোখের ইশারা করল।
—‘না হে, হবে না। আজ রাতের মতো সব শেষ। ঠিক আছে, নিগ্রো লোকটাকে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে পার তবে আমি ভেবে অবাক হচ্ছি, তুমি নিজেই ওর জন্য খাবার কিনে আনছ না কেন?’
মৃদু স্বরে শাপশাপান্ত করল বব। ঠিক আছে সে না হয় নিজেই খাবারদাবারের বন্দোবস্ত করবে। আপাতত বুড়োটাকে নিজের ঘরে নিয়ে যাওয়া যাক।
No comments:
Post a Comment