Thursday, 15 December 2011

বব উইলিস ও একটি কালো কোটের গল্প- পর্ব ৪

     রাস্তার পেভমেন্ট ধরে চলতে বব ভীষণ ভালোবাসে, কারণ জর্জটাউনের কোথায় কী হচ্ছে সে সব জানার সেরা উপায় হল ঐটে। এতে কি হয়, হাঁটার একঘেয়েমিটা কিছুটা কাটে। যেমন গত বিষ্যুদবার সে জেনেছিল শহরের নতুন রেস্তোঁরার উদ্বোধনের কথা এবং মেয়েদের নেলপলিশের নতুন ফ্যাশন। শহরের সবচেয়ে ধনী বাউন্ডুলে কিংবা দাবার কোনো নতুন চাল। মধ্যবয়সীদের পেছু পেছু হাঁটলে তাদের বিরক্তিকর স্ত্রীদের বিচিত্র খেয়ালের কথাও জানা যায়। লাঠি হাতে বুড়োগুলো সেরকম আকর্ষণীয় নয় কিন্তু ছেলে ছোকরাগুলো বেশ মজাদার। ওদের আলোচনা থেকেই বব জেনেছে যে জর্জটাউন পাবলিক স্কুলে এখনও নিগ্রো ছেলেমেয়েদের জল খাবার জায়গা আলাদা।
     কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, শীতের রাতে যখন চতুর্দিকে বরফ পড়ছে, অল্প কুয়াশায় দূরের কিছু দেখা যায় না, তখন লোকজন সব নিজের সাথেই একমাত্র কথা বলে। শীতকালেই বোধহয় সবাই তাদের নিজেদের স্বাস্থ্য, বাড়ীর মর্টগেজ, ছেলেমেয়েদের স্কুলের অনুষ্ঠান এবং নিজেদের জীবনের কথা ভাবে। মাথা নিচু করে ঘাড় গুঁজে যতটা সম্ভব ঠান্ডার আঁচড়কামড় বাঁচিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মানুষ নিজের কাছেই অজান্তে ফিরে আসে বারংবার। সুতরাং বব এমন একজনকেও পেল না যে তার ক্ষণিক আগেকার মহৎ কীর্তির কথা জানতে উৎসুক।
     অবশেষে রবিন্‌সের মুদিখানার কাছাকাছি পৌঁছে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। দরজা বন্ধ যদিও ভিতরে আলো জ্বলছে। চেস্টারের পাবে না হয় পরে যাওয়া যাবে, আপাতত রবিন্‌সকে একটু বাজিয়ে দেখা যাক, যদি কিছু সাহায্য পাওয়া যায়। রবিন্‌স কি সওদায় ব্যস্ত এখন? কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে একটি অল্পবয়সী মুখ দরজার ঝাপসা কাচের ওধারে উঁকি মারল।
—‘খোলো হে, যীশুর দিব্যি।’
অল্পবয়সী মুখের ছোকরাটি রবিন্‌সের ছেলে। ক্ষণিক ইতস্তত করে সে দরজা খুলে দিল। ভেতরটা বেশ গরম।
—‘আমি ভেবেছিলাম রবিন্‌সের সাথে দেখা করবো।’
‘কি চাই তোমার, বব’, উত্তর এল ঘরের কোণ থেকে। বড়সড় পশুচামড়ার কম্বল জড়িয়ে বেঁটে খাটো রবিনস কৌচের উপর বসে আছে। গ্যাসবাতির আলোয় ওর মুখটা পাঁশুটে দেখাচ্ছে। তার হাতে সকালের খবরের কাগজ, মুখে পাইপ। ঘরের ভেতর নানারকম মালমশলার ক্রেট। একপাশে উঁচু টেবিলের উপর বিভিন্ন প্রাচ্যদেশীয় মশলার প্যাঁটরা।
একটু কেশে গলা সাফ করে বব বলল, ‘একটু উপকার যদি কর রবিন্‌স।’
—‘তোমার কি মনে হয় না, আবহাওয়াটা ঠিক উপকার করার উপযুক্ত নয়?’
—‘তা বটে, তবে আমার শুধু একটু রুটি দরকার ছিল।’
—‘বেশ তো, এ আর এমন কি কথা। পয়সা ফেল, সানন্দে রাজী থাকব।’
বব একথায় একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলল, যেটা রবিন্‌সের নজর এড়াল না।
‘দেখো বব, এমনিতে আমি খুব খারাপ লোক কিন্তু আমার ঠাকুর্দার একটি শিক্ষা আমি পেয়েছি, সেটা হল ঘরের বউ এবং দোকানের মাল কখনো ধারে বেচতে নেই’, রবিন্‌স বিশ্রী ভাবে হেসে উঠল। সারা শরীর জুড়ে হাসছে। বব লক্ষ্য করল হাসির দমকে ওর মুখ লাল হয়ে উঠেছে।
বব স্থির করল, এই জাতীয় মানুষেরা মানবতার শত্রু এবং এদের কাছে মানুষের মহৎ প্রচেষ্টার কোনো দাম নেই। নেহাত মাইনের টাকা পয়সা সে উড়িয়ে দিয়েছে, না হলে রবিন্‌সের সাথে ফালতু বাক্যালাপ করার লোকই সে নয়। কুড়ি ডলার মাত্র তার সম্বল, হ্যামন্ড যাওয়ার ট্রেনভাড়া, কিছুতেই সে সেটাকে খরচ করবে না। সে ভাবল বুড়ো নিগ্রোটার স্বার্থে আরেকবার অনুনয় করে দেখবে।
—‘আমি অবাক হচ্ছি বব। হিগিন্‌স কি তোমার খেয়াল রাখছে না। নাকি রোজকারপাতি ছেড়ে দিলে?’
বব বিরক্ত হল। কোটের কলার থেকে বরফকুচি পরিষ্কার করতে করতে সে বলেই ফেলল আসল কারণ। এটাও জানাতে ভুলল না যে ঈশ্বর কালো মানুষদেরও নিজের সন্তান ভাবেন এবং পরের মাসে মাইনে পেলে সে প্রথমে রবিন্‌সের ধারই শোধ করবে।
—‘শোনো, তুমি ভুল দিনে এসেছো। সাধারনত রবিবার যখন গীর্জায় যাই তখনই একমাত্র আমি ধর্মপ্রাণ খ্রীষ্টান, বাদবাকি সময় আমি শয়তানের পরামর্শ অনুযায়ী চলি। যেমন এখন সে আমায় বলছে যে, তোমার উচিত আমার কুকুরটার জন্য কিছু খাবার কিনে দেওয়া কারণ, ওর গায়ের রঙও কালো।’
দড়াম করে দরজাটা টেনে বেরিয়ে এলো বব। আসার সময় সে শুনতে পেল, রবিন্‌স তুমুল হাসতে হাসতে বলছে, ‘নিগ্রোটাকে ধোলাই দেওয়ার দরকার পড়লে আমাকে বলো, বব। একাই আনন্দটা উপভোগ কোরো না যেন।’
নিপাত যাও! তোমার জন্য নরকও যথেষ্ট নয়। বব ভীষণ রেগেমেগে হন্‌হন করে চলতে লাগল। বুড়ো বেনসন জর্জটাউনের দোকানীদের যে মানুষ বলে গন্য করে না তার যথেষ্ট কারণ আছে তাহলে।
ক্রামার্স স্ট্রীটের শেষে আরো দু’টো বেকারী আছে। ববের মনে হল সব দোকানীই রবিন্‌সের মতো হৃদয়হীন হবে না নিশ্চয়।
     কিন্তু ববের কপাল মন্দ। দু’জায়গাতেই তাকে গলাধাক্কা খেল সে, এমনকি কিছু লোক বিদ্রুপ করতেও ছাড়ল না। কেউ কেউ গীর্জার কাজকর্ম সম্পর্কে তো সন্দেহই প্রকাশ করে ফেলল। হতাশ হয় বব যখন ভাবছে এরপর কোথায় যাওয়া যায়, ঠিক তখনই তার মনে হল ঈশ্বর বোধহয় ওই জমানো ডলারগুলোর ওপর বিরক্ত। ঠিক আছে, উপরওয়ালার ইচ্ছানুযায়ীই সে কাজ করবে। দাঁতে দাঁত চিপে সে সংকল্প করলো নিগ্রো বুড়োটাকে সে সুস্থ করে তুলবে, দরকারে তার নিজের জমানো টাকা খরচ করেই।
     রাগের চোটে কিছুক্ষণ এলোমেলো রাস্তায় ঘোরার পর অবশেষে কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সে মাথা নীচু করে রওনা দিল বাড়ির দিকে।

No comments:

Post a Comment