Sunday, 31 July 2011

হরিশরাজার জঙ্গলে- শেষ পর্ব

বনের অন্যপ্রান্তে নদীর ধারে চারজনে এসে উপস্থিত হলেন। বিকেল পেরিয়েছে। সূর্য ঢলে পড়েছে। পাখিরা সব সদলবলে বাসায় ফিরছে। নদীতে মৃদু স্রোত। গোবিন্দখুড়ো নদীর ধারে একটা বেশ বড় কালো পাথরের উপর বসে পড়লেন। এলোমেলো হাওয়ায় তাঁর চুল উড়তে লাগল।
     শতদল ঘোষ লাঠি নিয়ে এতটা পথ প্রায় তীর্থযাত্রীর মতো এসেছেন। হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, এখানেই অপেক্ষা করতে হবে বুঝি?
খুড়ো বললেন, যদি রুয়াৎ এর কবল থেকে বেরোতে পারে তাহলে এই খানেই দেখবে ওরা উদয় হবে।
গোপীনাথ কবিরাজমশাইয়ের গা ঘেঁষে একটা ঢিবির উপর বসেছেন। খুড়োর উত্তর শুনে প্রশ্ন করলেন, আর না হলে?
না হলে কোনদিনই ওদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওরা বুঝতেই পারবে না কখন ওরা দুম করে বাতাসে মিলিয়ে গেছে। কেউ ওদের আর দেখতে পাচ্ছে না। পাথরগুহা থেকে বেরোনোর রাস্তা ওই একটাই। তবে বড় শক্ত। অপেক্ষা কর হে মাস্টার।
কবিরাজমশাই চোখ বুজে গোয়েন্দা আর তার শাগরেদের জন্য প্রার্থনা করছিলেন। এবার চোখ খুলে বললেন, কিন্তু অসম্ভব নয়, তাই না?
তা তো বটেই। তবে সেরকম মনের জোর কী ওদের আছে? তাছাড়া ঘড়িটাকে যে উলটে দেবার কথা তারই বা কী হবে?
     শতদল ঘোষ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন হঠাৎ বনের ভেতর থেকে অদ্ভুত আওয়াজ শুনে থমকে গেলেন। আওয়াজটা প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে। শুনে মনে হচ্ছে যেন বিশাল বড় কোনো হাতি উন্মত্তের মতো ডালাপালা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এগিয়ে আসছে। ঘোষমশাই তার লাঠিটা বাগিয়ে ধরলেন।
     এদিকে খুড়ো পাথরের উপর থেকে নেমে পড়েছেন। উত্তেজনায় তাঁর চোখমুখ চকচক করছে। গোপীনাথ আর কবরেজমশাই একটু সন্ত্রস্ত হয়ে খুড়োর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
বেঁচে গেছে মনে হচ্ছে, প্রশ্ন হচ্ছে দুজনেই বাঁচল কী? খুড়ো বিড়বিড় করে উঠলেন।
বনের মধ্যে একটা বাজ পড়ার মতো আওয়াজ হল। তারপরেই সব চুপচাপ। একটা পোড়া পোড়া গন্ধ নাকে এল।
খুড়ো বনের ভেতর যেখান থেকে আওয়াজটা এসেছে সেদিক পানে দৌড়োলেন। তাঁর পিছু পিছু শতদল ঘোষ, গোপীনাথ আর কবরেজমশাই।
বনের ভেতর একটু এগোতেই দেখা গেল গবু এবং সত্যরঞ্জন হাত পা ছড়িয়ে চিৎপাত হয়ে এ ওর ঘাড়ে পড়ে আছেন। সংজ্ঞানহীন। একটু দূরে জগা পাগলা মস্ত বড় ঝোলা কাঁধে আঁতিপাঁতি করে কী যেন খুঁজছে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার যেটা সেটা একটু দূরেই শুন্যে ভাসছে। খুড়ো একগাল হেসে সেদিকে এগিয়ে গেলেন।
     কবিরাজমশাই নদীথেকে কোঁচাখানা জলে ভিজিয়ে চোপা চোপা করে ওঁদের মুখে জল ছিটোতেই সত্যরঞ্জন আঁকুপাঁকু করে উঠে বসলেন। কিছুক্ষন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকার পর ধরা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, কবিরাজমশাই, আমার পুরো দেহটাই কি দেখা যাচ্ছে?
কবিরাজমশাই স্মিত হেসে বললেন, চিন্তা কোরো না। পুরোটাই আছে। ধন্যি সত্যরঞ্জন। খেল দেখালে বটে।
গবুও উঠে বসেছে। কবিরাজমশাই তার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, তুমিও কম যাওনা বাপু।
ওদিকে গোবিন্দখুড়ো বালিঘড়িটা বগলদাবা করেছেন। ধীরে সুস্থে সেটাকে গামছাচাপা দিয়ে সত্যরঞ্জনের সামনে নিয়ে এসে ফ্যাকফ্যাক করে হাসতে লাগলেন। তা দেখে গবুর গা পিত্তি জ্বলে গেল। সত্যরঞ্জন রেগে মেগে বলতে লাগলেন, খুব যে হাসছেন, জানেন ওই বনের ভেতর কি আছে। জানেন কি সাংঘাতিক রকম বিপদের ঝুঁকি নিয়ে আমরা আপনার গুপ্তধন উদ্ধার করেছি, বলতে গেলে একরকম ওটা তো আমাদেরই, কই কোথায় সেটা, জগা পাগলা কই।
তখন সবাই ব্যস্ত হয়ে জগা পাগলাকে খুঁজতে লাগল। শেষমেশ শতদল ঘোষ তাকে করমচা গাছের পেছনে দেখতে পেলেন। তার কাঁধে তখনো মোহর ভর্তি ব্যাগ।
জগা পাগলা ব্যাগটা ধপাস করে সত্যরঞ্জনের পাশে রেখে বলল, এই নিন আপনার বেগুন, খেত থেকে এর বেশী আর পেলাম না।
সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্যাগ থেকে মোহর গুলো বার করে দেখতে লাগল। একটা মোহর দেখে গোপীনাথ বললেন, এ তো গুপ্তযুগের মনে হচ্ছে।
খুড়ো মাথা নেড়ে বললেন, তোমার ভুল হচ্ছে হে মাস্টার। গুপ্ত ফুপ্ত নয়, এ হল জমিদারবাড়ীর টাঁকশালে তৈরী মোহর। একেবারে আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি।
সত্যরঞ্জন তেরিয়া হয়ে বলে উঠলেন, কিরকম, কিরকম। উদ্ধার করলাম আমরা, আর এখন আপনি জমিদারবাড়ীর বললেই হল।
কবিরাজমশাই তাঁকে শান্ত করে বললেন, আহা খেপছ কেন। এ বিষয়ে পরে একটা শান্তিপুর্ণ সমাধান করলেই হবে। আপাতত গা ঝাড়া দিয়ে ওঠ, বাড়ী চল। তোমার গিন্নী তো ওদিকে নাওয়া খাওয়া ছেড়েছেন। কই হে গোবিন্দ এবার তোমার কাজ শেষ কর।
হ্যাঁ হ্যাঁ, এই যে, গোবিন্দখুড়ো গামছা সরিয়ে ঘড়িটা বের করলেন। উজ্জ্বল নিলাভ রঙে চারপাশ ছেয়ে গেল। ঘড়ির গোলাপী রঙের খোপ সাদা গুঁড়োতে প্রায় অর্ধেক ভর্তি হয়ে গেছে। খুড়ো ধীরে সুস্থে এবার সেটাকে উলটে দিলেন। সাদা গুঁড়ো গোলাপী খোপ থেকে নীল খোপের ভেতর পড়তে লাগল। মহা খুশি হয়ে খুড়ো সকলের দিকে চেয়ে একবার মুচকি হেসে নিলেন। 
ব্যস, আর কিছু না?
না হে কবরেজ, আর কিছু নয়। খুড়ো এই বলে ফের ঘড়িটাকে গামছা মুড়ী দিলেন। তারপর একগাল হেসে বললেন, তুমি ঠিকই বলতে হে, এতদিন অমানুষ ছিলাম, এইবারে পাকাপাকি মানুষ হব।
সত্যরঞ্জন কিছুই বুঝতে না পেরে হাঁ করে চেয়েছিলেন। কবিরাজমশাই তাঁর মনের অবস্থা আন্দাজ করে পিঠ চাপড়ে বললেন, চল হে যাওয়া যাক, যেতে যেতে তোমাকে সব খুলে বলব খন।
     সবাই মিলে উঠে পড়ে নদীর দিকে হাঁটা দিলেন। নদীর পাড় বরাবর চললে সোজা বাদাপুর ঘাট। সেখান থেকে হাঁসপুকুর বাজার চক বড়জোর দুক্রোশ। পা চালিয়ে চললে খুব বেশী রাত হবে না। বস্তাটা যেহেতু বেশ ভারী সেজন্য গোপীনাথ আর শতদল পালা করে বইতে লাগলেন। হাঁটতে হাঁটতে খুড়ো আর জগা পাগলার মধ্যে কালীগঞ্জের হাটে গামছার দর কত তা নিয়ে এক অদ্ভুত রকম আলোচনা শুরু হল। সত্যরঞ্জন কবিরাজমশাইকে তাঁদের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প বলতে বলতে চললেন। গবু হাত পা ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেখল সামনের বুনো লতাপাতার ঝোপের পাশে একখানা মোহর পড়ে আছে। কোনো সময় বস্তা থেকে পড়ে গেছে হয়তো। কাউকে কিচ্ছু না বলে মোহরখানা পকেটস্থ করে সে খুশি মনে হাঁটা দিল।
     আকাশে চাঁদ উঠে পড়েছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বনের ভেতর থেকে শেয়াল আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে একজন ওদের চলে যাওয়া বিষন্ন মনে লক্ষ্য করল। তারপর ট্যাঁক থেকে নস্যির কোটো খুলে একটিপ নস্যি নিয়ে ফের বনের মধ্যে ঢুকে গেল। তাকে অবশ্য কেউ দেখতে পাচ্ছিল না। তবে গগনবাবু শুনলে আশ্চর্য হতেন যে তাঁর চাকর ঝিকু মিঞা পৃথিবীর মায়া কাটালেও, নস্যির মায়া কাটাতে পারেনি।

No comments:

Post a Comment