Friday, 29 July 2011

হরিশরাজার জঙ্গলে- পর্ব ৩

জগা পাগলা, কালীবাড়ী থেকে তার প্রতিদিনের প্রসাদ খেয়ে সুরকিকলের গলি বেয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছিল, এমন সময় লক্ষ্য করল ফটিকদের বাঁশবনের পেছনে গোবিন্দখুড়ো গলায় গামছা দিয়ে ওত পেতে বসে আছেন। কাছে এসে একগাল হেসে জগা বলল, ‘বাঘ ধরছেন বুঝি নিতাই বাবু?’
গোবিন্দখুড়ো কিছুক্ষন চোখ পিটপিট করে বললেন, ‘জগা পাগলা মনে হচ্ছে।’
‘ধরেছেন ঠিকইএমন সুন্দর ডোরাকাটা ছোপ ছোপ, ইয়া বড় গোঁফ, আর ওই অত বড় ল্যাজ, নাহ, ও জিনিস বাঘ ছাড়া পাবেন কোথায়?’
খুড়োর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল, ‘বাঘ নয় রে ভাই, মনের মত একখান লোক খুঁজছি।’
‘তা এ আর কঠিন কি। দরকার শুধু টোপ। তা বাজার থেকে একখানা  পাঁঠা কিনে আনুন না?’
‘আহ মেলা বাজে বকিস না তো।’ খুড়ো খেঁকিয়ে উঠলেন।
‘অবশ্য আর একটা সহজ উপায় আমি জানি।’
‘বটে’, খুড়ো একটু সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘কি সেটা শুনি?’
হ্যা হ্যা করে খানিক হেসে জগা পাগলা বলল, ‘সোজা হরিশরাজার জঙ্গলে চলে যাও গুপীদাদু। ওখানে বুড়ো বটের নীচে পাথরগুহার সামনে গিয়ে পাকা আমটির মত বসে থাকো ওখানেই পাবে। অবশ্য বড় ছিপ নিয়ে যেতে হবে। নইলে ধরবে কি করে?’
খুড়ো সবেগে উঠে দাঁড়ালেন, উত্তেজনায় চুল খাড়া খাড়া হয়ে গেছে। গলার গামছাটাকে কোমরে জড়িয়ে বললেন, ‘তুই গিয়েছিস ওখানে? আবার যেতে পারবি?’
‘কি যে বলেন, সোনামুগের ডালের খোসবায় কি আর আমি জানি না, গেল হাটবারে সেই যে ওই যা ভুলে গেছি।’
‘আ হা হা, বাপ আমার, সোনামুগের ডালের কথা হচ্ছিল নাকি? বল দেখি ওই যে জঙ্গলের ভেতর যেখানে কাক পক্ষীও যায় না সেখানে তুই গিয়েছিলি নাকি?’
ঢুলুঢুলু চোখ করে জগা বলল, ‘আমিও তো সেই কথাই বলি সোনাকাকানা হয় শেষপাতে কুমোরদের বাড়ীতে মন্ডা কমই পড়েছিল তা বলে ঐ টক দৈ কি ভোলা যায় নাকি।’
খুড়ো জগাপাগলার আস্তিন ধরে মোলায়েম সুরে বলতে লাগলেন, ‘বাবা জগু আমার, মানিক আমার, বল না বাছা, গিয়েছিলি সত্যিকারের, হ্যাঁরে গিয়ে কি দেখলি, পাথরগুহায় ঢোকার রাস্তাখান দেখতে পেলি, বল না বাপ আমার, ইয়ে তোকে, কি বলে, অনেক টক দৈ খাওয়াব
‘বলছেন?’
‘একশোবার এই গামছা ছুঁয়ে বলছি।’
‘তাহলে শুনুন, প্রথমে কালীবাড়ীর কাছে যে তালঢ্যাঙা লম্বা সুপুরি গাছ টা আছে ওটা দেখেছেন তো, ওটার মাথায় উঠতে হবে
‘বেশ উঠলাম
‘ওঠার পর দেখলেন নীচে বড় বড় সব শুঁয়োপোকা উত্তর দিকে চলেছে। অমনি দুদ্দাড় করে নেমে এলেন।’
‘বেশ নামলাম
জগা সবেগে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘নেমে এলেই তো ভুল করলেন ওই গাছের পাশেই তো পুরোহিত মশাইয়ের বাড়ী, ঐ বাড়ীর ছাদেই তো যত ঢ্যাঁড়শ গাছ। আবার না উঠলে সেগুলো দেখতে পাচ্ছেন কোথায়?
—‘বেশ আবার নাহয় ওঠা গেল
‘উঠেই দেখলেন নীচে কালীবাড়িতে প্রসাদ দিচ্ছে। খেতে হবে তো, অমনি সটান নেমে এলেন।’
খুড়ো এবার ভীষন রেগে আস্তিন ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘হতভাগা, তখন থেকে খালি উঠছি আর নামছি। বলি বুড়ো মানুষ টার প্রতি একটুও দরদ হয় না তোর। সেই কবে থেকে হা পিত্যেশ করে বসে আছি। বলি বল না হতভাগা বনের মধ্যে পাথরগুহার ওখানে গেলি কি করে।’
জগা পকেট থেকে একটা পেয়ারা বার করে কামড় দিয়ে বলল, ‘আমিও তো সেইকথাই ঝিকু কে বললাম।’
‘অ্যাঁ, বলে দিলি, তুই বলে দিতে পারলি, বলি আগে তো সুলুকসন্ধান করে নিয়ে দেখতে হয় রে বোকা ও যে আমার হকের ধন’, খুড়ো ফোঁত ফোঁত করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন। কোমরের গামছার খুঁট টা খুলে খানিক চোখ মোছা হল।
‘সেই কবে বাপ পিতেমোর আমল থেকে শুনে আসছি। একএকটার ওজন নাকি চোদ্দ ভরি। বনের মধ্যে পাথরগুহার খাঁজের মধ্যে নিতান্ত হেলাফেলা হয়ে পড়ে রয়েছে। আ হাহা, হয়তো পালিশ উঠে গেছে। আমার বংশের সবেধন সম্পত্তি, এখন আমি যদি ওগুলোয় নিদেনপক্ষে একটু হাত বুলোতে চাই তবে কী অধর্ম করলাম তুই বল আমায়। হা ভগবান, হা হতোস্মি।’
জগা একটু কাষ্ঠহাসি হেসে বলল, ‘বুনোকুল খেতে চান যদি, তো আগে বললেই হয়। জঙ্গলের ভেতর ওই যে যেখানে তিনবার ঘড়ির ঢঙ শোনা যায় ওখানে তো মেলা কুল গাছ।’
খুড়ো আর থাকতে পারলেন না। মুখে হাত দিয়ে ভেউ ভেউ করে কেঁদে বললেন, ‘ও জগা সবই তো বলছিস ভাই, খালি এইটুকু বলে দে আমার সাত রাজার ধন মানিক ওখানেই আছে কিনা। ও হো হো, কি গেরোয় পড়েছি রে ভাই।’
‘দুত্তোর তারপর শুনুন, সেই কবে একটা কে যেন পেয়ারা গাছের তলায় মাচা বানিয়ে ছিল, তারপর ভাত রান্না করে ওখানে খুব করে ডাল দিয়ে মেখে
খুড়ো চোখ মুছে বললেন, ‘বুঝেছি রে বুঝেছি, আর বলতে হবে না, তোর খিদে পেয়েছে তো, চল ভাই আমার সাথে। তোকে আমি রেঁধে খাওয়াব। কাল হরেন যে লালশাক গুলো দিয়ে গেল ও তো এমনই পড়ে আছে।’
জগা ফিক করে হেসে বলল, ‘তবে খাল পাড়ে কোথায় কাঁকড়ার গর্ত আছে সে কি আর আমি কাউকে বলেছি।’
খুড়ো হতাশ হয়ে বললেন, ‘সে কি আর আমি জানি না রে। এই ঘোর কলিযুগে কেউ কি কাউকে আসল গুহ্য কথাটা বলে রে, নাকি যে যেটা খুঁজছে সেটা পায়। এই আমাকেই দেখ না, কতদিন ধরে এমন একজন লোকের সুলুক সন্ধান করছি যাকে দিয়ে কিনা কার্যোদ্ধার হবে, তা এমনি পোড়া কপাল যে পুরো গোটা একটা ভালো লোক পেলুম না মাইরি। এই যখন তোকে পেলাম, তুই আবার তাও লেজে খেলাচ্ছিস। হ্যাঁরে পাগল বলে কি দয়ামায়া থাকতে নেই।’
—‘তা কেন? এই তো সেদিন রাধাকান্তবাবুর ট্যাঁকঘড়িটা পষ্ট দেখলাম হাবু চোর হাতিয়ে নিল।’
—‘চল বাবা চল। বেশ বুঝেছি তোর উপরই বেবাক হাঁ করে বসে থাকতে হবে। বেলা হয়েছে, আজ না হয় আমার বাড়ীতেই দুটি ভাত খেয়ে যাবি।’
—‘এই রে মনে পড়েছে। ও দাশুখুড়ো আমাকে আজ ছেড়ে দাও, আজ আবার ঘড়ি উল্টোতে যেতে হবে।’
—‘অ্যাঁ
—‘বুঝছ না নবীন ভায়া। পাথরগুহার ভেতর ঐ লাল-নীল ঘড়িটা উলটে দিয়ে আস্তে হবে না, না হলে স্লো চলবে তো।’
আঁক করে শব্দ করে গোবিন্দখুড়ো ভিরমি খেয়ে পড়লেন। জগা খুব খুশি হয়ে বললে, ‘তাহলে রাজাবাবু, পাকা তেলাকুচো লাগলে বলবেন, খানিক দিয়ে যাবখন, আচ্ছা আসি এখন।’ এই বলে ফটিকদের বাঁশবনের পেছন দিক দিয়ে যে রাস্তাটা সোজা বিল পেরিয়ে হরিশরাজার জঙ্গলের দিকে গেছে সেদিকে হাঁটা দিল।

No comments:

Post a Comment