গত দুদিন একটু বাদলা করেছিল, এখন আবার আকাশে নীল রঙ ধরেছে। শীত আসছে গুটি গুটি পায়ে। হাঁসপুকুরের উত্তরে চাষের জমির ধান তোলার জন্য দুরের গ্রাম থেকে লোক লশকর সব আস্তে শুরু করেছে। চন্ডীমন্ডপে অপেরা বসবে, তার জন্য চৌধুরী মশাই দৌড়দৌড়ি শুরু করেছেন। চারদিকে বেশ খুশী খুশী ভাব।
স্নান আহ্নিক সেরে, কবিরাজমশাই গায়ে শাল জড়িয়ে গুপী মাস্টারের বাড়ীর দিকে রওনা দিলেন। গুপী মাস্টারের বাড়ি বাজার ছাড়িয়ে গ্রামের প্রায় শেষ দিকটাতে। মাস্টারের সাথে একটু শলা পরামর্শ করা দরকার। বড় মন খুঁতখুঁত করছে।
গুপী মাস্টার অর্থাৎ হাঁসপুকুর কালীসুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয়ের অঙ্কের মাস্টার গোপীনাথ বর্মনকে তাঁর রাশভারী মেজাজের জন্য ছেলেমেয়েরা ভয় পায়। তবে কবিরাজমশাই তাঁকে স্নেহ করেন। অঙ্কে তাঁর মাথা বড় সাফ। এরকম লোক গ্রামে অবশ্যি দরকার, বিপদে আপদে দরকারী পরামর্শ পাওয়া যায়।
গুপী মাস্টারের একতলা বাড়ী। সামনে বেড়া দেওয়া গোলাপ বাগান। মরসুমি ফুল লাগানো হয় মাঝে মাঝে। সামনে বেশ বড়সড় নিম গাছ। ভদ্রলোক অবিবাহিত। কবিরাজমশাই বাড়ীর সামনে এসে হাঁক দিলেন, ‘মাস্টার আছ নাকি?’। আগেই খবর পাঠানো ছিল, গোপীনাথ সবুজ-সাদা চেক কাটা লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে বাইরে বেরিয়ে এলেন।
—‘আসুন কবরেজমশাই।’
—‘শোনো হে তোমার সাথে কিছু পরামর্শ করার ছিল।’
—‘বেশ তো, আগে ভেতরে আসুন।’
কবিরাজমশাই ভেতরে ঢুকলেন। দেওয়ালে নানান মনীষীদের ছবি টাঙান। সামনে টেবিলে নানান বইপত্র।
—‘আজ তোমার সব পড়োরা কোথায়?’
—‘আপনি আসবেন বলে ছুটি দিয়েছি। ব্যাপার কি কবিরাজমশাই?’
জল-বাতাসা খেয়ে ধীরেসুস্থে কবিরাজমশাই বললেন, ‘গাঁয়ে কিসব অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার ঘটছে, তার খবর রাখো?’
—‘কি হয়েছে?’
—‘নানান আজব ব্যাপার স্যাপার। আজ সকালে আমাদের বিশু আর দারোগা দুগ্ধবরন, দুজনের মুখেই শুনলাম।’
—‘গোবিন্দনারায়ন বাবুকে নিয়ে কি?’
কবিরাজমশাই সচকিত হলেন। গলা খাটো করে বললেন, ‘তুমিও কিছু দেখেছ নাকি?’
—‘ইয়ে, কাল দুপুরে উনি আমার বাড়ীর নিমগাছে ঘাপটি মেরে বসে ছিলেন। আমায় দেখতে পেয়ে নেমে এসে গল্পগুজব করলেন, তারপর যাবার সময় একটা ভীষন শক্ত অঙ্ক দুমিনিটে কষে দিয়ে চলে গেলেন।’
—‘বল কী!’
—‘আজ্ঞে হ্যাঁ, তবে আমি যতদুর জানি উনি কোনকালে আঁক কষা শেখেননি।’
—‘আরে আঁক কষা তো দুরের কথা, ও তো কোনকালে লেখাপড়ার ধার দিয়েই গেল না হে। অবশ্য দৌড়ঝাঁপ করত বেশ ভালো। অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার, কুস্তি সবেতেই পারদর্শী ছিল।’
গোপীনাথ কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন, শেষে বললেন, ‘কবিরাজমশাই, আমার চেয়ে এ গাঁয়ের হাঁড়ির খবর আপনি বেশী জানেন।’
কবিরাজমশাই ইঙ্গিত বুঝলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ভয় কী জানো, বাবার কাছে শুনেছি, গোবিন্দর বাবা উপেন্দ্রনারায়ন উবে যাওয়ার আগেও নাকি ঠিক এই রকমই হয়েছিল। নানান রকম অদ্ভুত ক্ষমতা দেখা দিয়েছিল।’
—‘উবে গিয়েছিলেন মানে?’
—‘হরিশরাজার জঙ্গলে শেষ তাঁকে ঢুকতে দেখা যায়। তারপর গায়েব। গ্রামের লোক নাকি অনেক খোঁজাখুঁজি করেছিল।’
গোপীনাথ ধন্দে পড়লেন। ঠিক কিরকম ক্ষমতা ছিল উপেন্দ্রনারায়নের।
—‘তা হলে বলি শোন। আমার বাবার মুখে শোনা। তখন বেশ স্বচ্ছল অবস্থা ছিল চক্রবর্তীদের। শীতের শেষে নতুন ধান বোনার আগে ওদের বাড়ীর রোয়াকে প্রতিবছর কেতাবী গানবাজনার আসর বসত। কলকাতার নামী সব গাইয়েরা আসতেন। একবার এক পন্ডিতজী এলেন, বেহাগ রাগে আলাপ ধরার পর যেই বিলম্বিতে এসেছেন অমনি উপেন্দ্রনারায়ন উঠে দঁড়িয়ে পন্ডিতজীর ভুল ধরে দিলেন।’
—‘বলেন কী!’
—‘হ্যাঁ, অথচ ওনার কোন রেওয়াজী শিক্ষা মোটেই ছিল না।’ কবিরাজমশাই চুপ করলেন। ‘আরোও শুনবে?’
—‘বলুন।’
—‘রসিকবিল তখন আরো বড় ছিল, আরো গভীর। নদীর সাথে যোগও ছিল। তো সেই নদীতে এক বার শরতের রাতে উপেন্দ্রনারায়ন স্ত্রী সমেত নৌকাবিহার করছেন বুঝলে। স্ত্রী সৌদামিনী অভ্যাসবশত জলে হাত দিয়ে আদিখ্যেতা করছেন। এমনসময় হাতের আঙুল থেকে আঙটি খুলে টুপ করে পড়ে গেল জলে। প্রথম চোটে বোঝেননি, তারপর ডাঙায় নেমে দেখলেন আঙটি নেই, ব্যস হুলুস্থুলু কান্ড, উপেন্দ্রনারায়ন তারপর কী করলেন বলত?’, কবিরাজমশাই গোপীনাথের দিকে তাকালেন।
—‘বুঝতে পারছি কবিরাজমশাই, উনি আবার ডুব দিয়ে বিলের তলা থেকে ওই অন্ধকারে আঙটি তুলে আনলেন, তাই তো?’
—‘একদম ঠিক।’
‘কিন্তু কবিরাজমশাই, এগুলো তো গুজবও হতে পারে।’ গোপীনাথের ভ্রু কুঞ্চিত হল।
কবিরাজমশাই মৃদু হাসলেন, ‘না হে, ব্যাপারটা সত্যি। কারন চক্রবর্তীদের বাড়ীর দোতলা থেকে আমার বাবা পুরো ব্যাপারটাই দেখেছিলেন।’
—‘আপনি বিশু আর দারোগাবাবুর কথা বলছিলেন না?’
—‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ওদের দুজনের বক্তব্যই মোটামুটি এক, দুজনেই দেখেছে গোবিন্দ অন্ধকারেও পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে।’
গোপীনাথ চমৎকৃত হলেন। ‘কিন্তু কবিরাজমশাই, বিজ্ঞান তো তা বলে—’
—‘বিজ্ঞানের এখনো অনেক কিছু শেখা বাকী আছে হে গোপীনাথ।’
গোপীনাথ তর্কে গেলেন না। হতে পারে গোবিন্দনারায়নের অতিমানবিক ক্ষমতা আছে। কিন্তু সে তো কতই শোনা যায়। প্রায়শই খবরের কাগজে সাংবাদিকরা ফলাও করে লেখে, সেই যে চামচ বাঁকানোর গল্প, জলের তলায় শ্বাস বন্ধ করে বসে থাকার গল্প। মানুষ নিজেকেই বা চেনে কতটুকু।
কবিরাজমশাই গোপীনাথের মনের অবস্থাটা আন্দাজ করলেন। আর একটু জল খেয়ে, কেশে গলা সাফ করে বললেন, ‘বুঝলে ঝিকু মিঞাকে পাওয়া যাচ্ছে না।’
—‘সে কী!, ঝিকু মানে গগনবাবুর চাকর?’
—‘হ্যাঁ হে, সেই। সে নাকি কাল সন্ধ্যাবেলা হরিশরাজার জঙ্গলে ঢুকেছিল।’
‘বলেন কী’, গোপীনাথ নড়েচড়ে বসলেন। ‘এত জায়গা থাকতে হরিশরাজার জঙ্গলে কেন?, ও তো শুনি খুব একটা ভালো জায়গা নয়। পুলিসে খবর দেওয়া হয়েছে?’
—‘পুলিশ এখনো জানে না, মানে তাদের জানানো হয় নি, আর ঠিকই শুনেছ ও জঙ্গল মোটেও সুবিধার জায়গা নয়, আহা দাশুবাবুর জোয়ান নাতিটা!’
দুজনেই কিছুক্ষন চুপ করে বসে রইলেন। শেষে গোপীনাথ মুখ খুললেন, ‘আপনি কি কোনোভাবে ঝিকুর জঙ্গলে যাওয়া আর গোবিন্দবাবুর অলৌকিক ক্ষমতার মধ্যে কিছু যোগাযোগ আছে বলে মনে করছেন?’
কবিরাজমশাই একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘কিছুই অস্বাভাবিক নয় হে। শাস্ত্রে বলেছে সিংহের গুহায় মৃগ এমনি এমনি যায় না।’
—‘সব রহস্যই তো হরিশরাজার জঙ্গলে গিয়ে ঠেকছে বলে মনে হচ্ছে। আচ্ছা কবিরাজমশাই আপনি গোবিন্দবাবুকে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করছেন না কেন?’
কবিরাজমশাই একটু অস্বস্তিতে পড়লেন। কিছুক্ষন উশখুশ করার পর বললেন, ‘আসলে গতবছর বুঝলে, ওই চৌধুরীর ‘রাবণেরর আর্তনাদ’ পালা দেখার পর থেকেই ওর সাথে বড় মনোমালিন্য।’
—‘ঝগড়াটা কি নিয়ে?’
‘ইয়ে’, কাষ্ঠহাসি হেসে কবিরাজমশাই বললেন, ‘ঐ কার চরিত্র বড়, মেঘনাদ না বিভীষন, সেই নিয়ে।’
ঝপ করে বিজলি চলে গেল। অবশ্য ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। গোপীনাথ বেশ চিন্তায় পড়লেন। হরিশরাজার জঙ্গলে আছেটা কী? তিনি নিজে হাঁসপুকুর আসা ইস্তক শুনছেন ও বড় ভয়ের জায়গা। যদিও দিনমানে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। তাছাড়া গোবিন্দনারায়নের বংশপম্পরায় এরকম অলৌকিক শক্তির রহস্য কী? উপেন্দ্রনারায়ন হঠাৎ হরিশরাজার জঙ্গলেই বা কি করতে গিয়েছিলেন।
—‘তুমি একটু ভাব হে গোপীনাথ। আমি এখন উঠি।’
কবিরাজমশাই উঠে পড়লেন। রোদ পড়ে এসেছে। গ্রামের আরো কয়েকজনের সাথে শলা পরামর্শ করতে হবে। গোপীনাথ কবিরাজমশাইকে একটু এগিয়ে দিতে গেলেন।
—‘ভালো কথা, তুমি কোনোদিন গোবিন্দনারায়নের বাড়িতে গেছ নাকি?’
—‘ইয়ে না তো, ও হ্যাঁ, বোধহয় একবার। ইস্কুলের মাঠের জন্য ওঁদের রসিকবিলের পাশে যে জমিটা আছে ওটা ডোনেশন হিসেবে পাওয়া যেতে পারে কিনা সে ব্যাপারে কথা বলতে। কেন বলুন তো?’
—‘ওদের, বৈঠকখানায় হরিণের মুন্ডুর পাশে যে মুর্তিটা রাখা আছে দেখেছ।’
—‘না খেয়াল করিনি তো। কেন কিছু অস্বাভাবিক আছে নাকি?’
—‘কোনো মানুষের চারহাত লম্বা ল্যাজ হয় দেখেছ নাকি?’
No comments:
Post a Comment