এতো জানা কথাই যে প্রতিদিন সকালে বাজার চকের মোড়ে জলবেহারীর সেলুনের দোকান সবার আগে খুলে যায়। গদাই পালোয়ানের কুস্তির আখড়ায় ভিড় জমে। জীবন তার দোকানের সামনে উনুনের উপর রাখা বিরাট বড় কালো কড়ায় ছাঁকা তেলে সিঙাড়া ছাড়ে। চৌধুরী মশাই মাছস্বপনের কাছে পোনামাছের দরদাম করেন তবে তার আগে চট করে গাজর কিনে নেন। পাশের গ্রাম থেকে ছেলেমেয়েরা সাইকেল চালিয়ে ইস্কুলে আসে এবং হাঁসপুকুর কো অপারেটিভ ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার নবীন স্যান্যাল সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে গোনাগুনতি তিনবার হোঁচট খান।
তবে এই রোজকার ঘটনার পাশাপাশি চায়ের দোকানের গুলবাজরা লক্ষ্য করল বাজারের মাঝখানে ছোট করে শামিয়ানা খাটানো হয়েছে। গুটি কয়েক চেয়ারও রাখা। অবনী ডেকরেটার্সের লোকজন, মাইক চোঙা ইত্যাদির জোগাড়যন্ত্র করছে। এবং এটাও চোখে পড়ছে মঞ্চের সামনে বিরাট বড় হোর্ডিং এ লেখা রয়েছে, ‘জগা পাগলা বাঁচাও সমিতি’।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শামিয়ানার সামনে লোকজন জড় হতে লাগল। একই সাথে হাঁসপুকুর নির্বান্ধব সমিতি, হাঁসপুকুর নজরদারি সমিতি ও হাঁসপুকুর পুকুরচুরি বন্ধ কর সমিতির প্রেসিডেন্ট এবং সুবিখ্যাত হাঁসপুকুর স্টেশনারির মালিক শতদল ঘোষ এসে পড়ে তদারক করা শুরু করলেন। লাল শালু দিয়ে মঞ্চ খাটানো হয়েছে। মঞ্চের উপর বেতের লাঠিতে সভাপতি লেখা একখান কাগজ সাঁটা। তার তলায় একটি তীরচিহ্ন। কবিরাজমশাই ও গোপীনাথ বর্মন মঞ্চে উঠে এক কোনে দুখানি চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। গদাই পালোয়ানের আখড়ায় ছেলেরা কুস্তি করছিল। ব্যাপার স্যাপার দেখে তারা সবাই এগিয়ে এসে মুন্ডু বার করে দেখতে লাগল।
শতদল ঘোষ মঞ্চে উঠে তীরচিহ্নের তলায় বসে পড়লেন। চোখে মুখে আত্নপ্রসাদ ঝরে পড়ছে। রসে ডুবুডুবু অবস্থা যাকে বলে। পকেট থেকে সাদা কাগজে লেখা বক্তৃতাটা আরেকবার ঝালিয়ে নিলেন। বিশেষতঃ ঐ যেখানে মাতঙ্গিনী আর সুভাষের কথাটা বলতে হবে, সেখানে গলা একটু না কাঁপিয়ে বললে চলবে কেন? দরদর করে ঘামছেন। সাদা ফতুয়া ঘামে ভিজে গেছে।
একটু পরে কবিরাজমশাই পেছন থেকে ঠেলা মেরে বললেন, ‘কই হে এবার শুরু কর।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই যে’ বলে ঘোষমশাই উঠে দাঁড়ালেন। তারপর মাইক টেনে নিয়ে মোলায়েম সুরে বলতে লাগলেন, ‘হে আমার হাঁসপুকুরের ভাই ও বোনেরা, তোমরা কী জান আজ আমরা কিসের জন্য এখানে জমায়েত হয়েছি। আজ এই সমাবেশের হেতু হল জগা পাগলা। তার স্মৃতিতে এই হাঁস—’
কবিরাজমশাই পেছন থেকে খাটো গলায় বললেন, ‘মরে গেছে ধরে নেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?’
—‘হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকই তো। যাইহোক, মোটমাট জগা পাগলই আমার বক্তব্যের বিষয়। এ ব্যাপারে বলতে হলে প্রথমে আমাদের বলতে হয় পাগল কেন দরকার। আবার হাঁসপুকুরেরই পাগল কেন দরকার। পাগল কোনো উপকারী জীব নয়, গোরু নয় যে দুধ দেবে, পাঁঠা নয় যে মাংস হবে এমনকি বুদ্ধুও নয় যে দারোগা হবে—’
জনতা সোৎসাহে হাততালি দিল।
‘হ্যাঁ যা বলছিলাম’, কপালের ঘাম মুছে শতদল ঘোষ ফের বলতে থাকলেন, ‘তাহলে পাগল থাকলেই বা কী হচ্ছে আর না থাকলেই বা কী। ভেবে দেখুন ভাইসকল, সমাজে একটা পাগলের থাকাটা কত জরুরী দরকার আবার না থাকাটাও কত জরুরী। ইয়ে, তবে থাকার দিকটাই বেশী বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু কেন?’
জনতা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
—‘পাগল আছে বলেই তো আমরা বলি, পাগলে কী না বলে ছাগলে কী না খায়। ভেবে দেখুন এই যে কথায় কথায় আপনারা সব বলছেন পাগলের হদ্দ, পাগল না থাকলে কী আর সেই সুবিধা পেতেন। পাগলরা কোথায় নেই বলুন, সাপ, ব্যাঙ, হাতি, ঘোড়া, লুডো, সব জায়গায় ওরা আছে। তাছাড়া কত দরকারী অদরকারী পরামর্শ পাওয়া যায়। ভেবে দেখুন জগা পাগলা ছিল বলেই তো বলতে পেরেছিল, রাবনের আর্তনাদ পালায় রাবন নাকিসুরে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদবে নাকি ভেউ ভেউ করে মুখ ঢেকে কাঁদবে। তারপর ধরুন রসিকবিলে মাছ ধরার টোপ হিসেবে ওই তো বলেছিল কেঁচোর সাথে পিঁপড়ের ডিম নয় ময়দা ঠাসতে। আজ এই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমার কত কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে, ও হো হো হো।’
ফোঁত ফোঁত করে খানিক কেঁদে রুমালে মুখ মুছে শতদল ঘোষ ফের বলতে শুরু করলেন, ‘ভাইসব, আমাদের হাঁসপুকুরে জগা পাগলের মতো পাগল অবশ্যই চাই। একধাপ এগিয়ে আমি দাবী করছি, সরকার বাহাদুর যেন প্রত্যেক গ্রামে একজন করে এরকম পাগল পাঠান। আজ জগার স্মৃতিচারনায় আমার বার বার এই কথা মনে হচ্ছে যে, যে জাতি একদা মাতঙ্গিনী, সুভাষ বোসের মতন দেশপ্রেমিকদের দেখেছে, আজ জগা পাগলের জন্য সে কাতর—’
কবিরাজমশাই শতদল ঘোষের কোঁচার খুঁটে একটু টান মেরে বললেন, ‘আহা আসল কথাটা বল না হে।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা তো বটেই, তা তো বটেই, হয়েছে কী ভাইসকল, জগা পাগলাকে মোটেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হাঁসপুকুরের সমস্ত গাব গাছ ভালো করে খুঁজে দেখা হয়েছে। সমস্ত খড়ের গাদা, নদীতে যত গাধাবোট, কালীবাড়ীর রোয়াক, ইস্কুলবাড়ী, এই বাজারচকের আনাচকানাচ, চৌধুরী মশায়ের অপেরা হাউস, হাঁসপুকুরের যত গোয়াল, হেঁসেল মায় খাটের তলা, কিছুই বাদ পড়ে নি। বিশ্বস্ত সুত্রে আমরা খবর পেয়েছি, সে নাকি হরিশরাজার জঙ্গলে সেঁধিয়েছে। হয়ত কেউ তাকে খেপিয়েছে, পাগল বলে গাল পেড়েছে, আর তাই আমাদের সাধের জগা পাগলা মনের দুঃখে শ্রীচৈতন্যের মতো দেশত্যাগ করে জঙ্গলে গেছেন। এখন তাঁর মানভঞ্জন করে তাঁকে ফিরিয়ে আনাটা আমি আমাদের কর্তব্য বলে মনে করি, বিশেষতঃ তোমরা সবাই তো জানই ওই জঙ্গলে, ইয়ে কী বলে কী সব নাকি রয়েছে।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে শতদল ঘোষ বসে পড়ে হাঁপাতে লাগলেন।
তখন কবিরাজমশাই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমাদের একটা সার্চ পার্টি দরকার। কে কে ওই বনে যেতে রাজী আছো।’
ভীড়ের মধ্যে থেকে কে যেন চেঁচিয়ে বলল, ‘পুলিশ কে বললেই তো হয়।’
কবিরাজমশাই জানতেন চট করে কেউ রাজী হবে না, শান্ত গলায় বললেন, ‘দারোগা দুগ্ধবরনের সাথে আমার কথা হয়েছে, উনি যেতে রাজী হয়েছেন, তবে এও বলেছেন যে, এই সমস্ত সংস্কারমূলক কাজে জনসাধারনের উপস্থিতি ও অংশগ্রহন একান্ত কাম্য।’
সামনের সারিতে গগনবাবু দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন, ‘ওখানে যে কী সব আছে শুনি। ঐ যে কীসব যেন, গেলেই খপ করে ধরে।’
—‘যা শুনেছ তার কিছুটা হয়তো সত্যি। আমি কিছুই লুকোব না। হয়তো প্রানের ভয়ও আছে। অপদেবতারা আছেন কি না জানি না তবে এটুকু আমি নিশ্চিত যে ওখানে অদ্ভুতুড়ে কান্ডকারখানা হয়।’
শতদল ঘোষ ফের উঠে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, ‘হে আমার হাঁসপুকুরের সাহসী বীর ভাইসকল, আজ এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে দেশমাতৃকা আমাদের ডাকছে। সেই যে কে যেন বলেছিলেন, কীসব যেন ডাক দিয়েছে, আয় রে ছুটে আয়। আজ সব ছুটে ছুটে এসো, হাঁসপুকুরের পরমহংসেরা। এই অদ্ভুত অভিযানে আমি তোমাদের নেতৃত্ব দেব। তোমরা আমাকে সাহস দাও, আমি তোমাদের জগা পাগলা দেব। এখন চট করে বলে ফেল কে কে আমাদের সঙ্গে যাবে।’
কেউ অবশ্য হাত তুলে এগিয়ে এল না।
No comments:
Post a Comment