বনের এ অংশ বেশ পাতলা, ফাঁকা ফাঁকা। বুনো কাঁটা ঝোপ ঝাড় একটু কম। ত্রিকোনাকার সবুজ পাতাওলা নরম ন্যাতানো একধরনের গুল্ম জাতীয় গাছে ভর্তি। হঠাৎ দেখলে মনে হয় কে যেন সবুজ গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। লম্বা লম্বা গাছের সংখ্যাও বেশ কম। আর তাদের ডালপালাও অত বিস্তৃত নয়।
সত্যরঞ্জন বারবার নকশায় চোখ রাখছিলেন। পাথরগুহা কাছাকাছিই কোথাও হবে। অন্তত ম্যাপে সেরকমই তো বলা আছে। ম্যাপটা অবশ্য বড্ড সহজ সরল। কোথাও কোনো কিছু সাঁটে বলা নেই। একটুও রহস্য রোমাঞ্চের গল্পগুলোর মতো নয়। সেই যে পুরোনো কাগজে বড্ড শক্তরকমের ধাঁধা লেখা থাকে আর গোয়েন্দারা সেসব উদ্ধার করতে গিয়ে মাথার চুল ছেঁড়েন। কোনো ক্লু পাওয়া যায় না। শেষমেশ হঠাৎ কেমন সব হুড়ুদ্দুম ঘটনা ঘটে আর সঙ্গে সঙ্গে ধাঁধার মানে বোঝা যায়। সেরকম এটাও হলে সোনায় সোহাগা হত। ম্যাপটা এত সহজ সরল হবার মানে কী? আহা বেশ জম্পেশ করে যদি রহস্যখানা সমাধান করা যেত তবেই না ঐ পিসে আর তার ভাইঝির মুখে চুনকালী পড়ত।
ভাবতে ভাবতে সত্যরঞ্জন উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। এইসব গুপ্তধন ইত্যাদি তো প্রায় তাঁর হাতের মুঠোয়। তিনি মনশচক্ষে দেখতে পেলেন ফেরার পর তাঁকে ঘিরে গঞ্জে তুমুল হৈ চৈ হচ্ছে। বড় বড় পোস্টার পড়েছে। দুরদুরান্ত থেকে লোকে তাঁকে দেখতে আসছে। বাজার চকের মাঝখানে তাঁর চেম্বারে কী ভিড়। গবু দিস্তা দিস্তা পাতায় লোকজনের কেস ডায়েরি নিচ্ছে। নাওয়া খাওয়ার জো নেই। সত্যরঞ্জন আরো দেখতে লাগলেন ক্ষীরপুলির বাটি হাতে লালপেড়ে গরদের শাড়ি পরে কে যেন অফিসঘরে ঢুকছে। খাও খাও বলে সাধাসাধি করছে। হুঁ হুঁ বাবা, এইবার? ভাবাবেশে সত্যরঞ্জনের চোখ বুজে এলো। তিনি আয়েশ করে ভাবতে লাগলেন, ঐ সেয়ানা পিসেমশাই দস্তুরমতো অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার জন্য সকালথেকে তাঁর চেম্বারে এসে বসে আছেন। আর সেসবের তোয়াক্কা না করে উর্দি পরা দারোয়ানকে তিনি হুকুম দিচ্ছেন, ‘এই পাহারাওয়ালা বান্দরলোগোকো বাহার ফেকো।’ আহা, কী সুখ।
হঠাৎ পেছন থেকে গবুর চীৎকারে সত্যরঞ্জন আঁতকে উঠলেন। আহা বেশ সুন্দর একটা ভাব মাথাচাড়া দিচ্ছিল। দিলে দফা রফা করে। বেজায় ক্ষিপ্ত হয়ে সত্যরঞ্জন পেছনে ঘুরে দেখলেন গবু হাঁ করে তাঁর দিকে চেয়ে আছে।
—‘কি হলো। অমন করে চীৎকার করলি কেন?’
—‘আ-আপনার পা।’
—‘আমার পা! আমার পা মানে?’
—‘আ-আপনার পা! নে-নেই!’
সত্যরঞ্জন ভীষন রেগে গিয়ে বললেন, ‘দেখ ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। আমাকে এমন করে ভয় দেখাবি না বলে দিলুম। জলজ্যান্ত নিজের পা দুখানা পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তুই বললেই হল নেই। আরে পা নেই তো দাঁড়িয়ে আছি কী করে রে হাঁদারাম।’
গবু ভালো করে চোখ কচলাল। তারপর আরো জোরে চীৎকার করে উঠল, ‘আজ্ঞে বিশ্বাস করুন। হাঁটুর নীচ থেকে আপনার পা দুখানা বেবাক গায়েব হয়ে গেছে।’
সত্যরঞ্জন ফ্যাকাসে মেরে গেলেন। বলে কী? পা নেই? কিন্তু তিনি তো দুখানা পাই দেখতে পাচ্ছেন। এই তো তাঁর কবেকার বাদামী কালো পাম্পশু, হাঁটুর নীচ থেকে নীল রঙের মোজা, সবই তো জলজ্যান্ত বর্তমান। তাহলে গবু বলছে টা কী?
‘ওই ওই!’ গবু আবার চেঁচিয়ে উঠল।
সত্যরঞ্জন শুকনো গলায় বললেন, ‘এবার কী মিসিং?’
—‘না না, এই তো পা দুটো আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে।’
বলে কী! গোলগাল পা দুটো তিনি দিব্যি দেখতে পাচ্ছেন, আর এ ব্যাটা বলে কিনা আসতে আসতে ফুটে উঠছে। এ কি পা না ভোরের আলো! সত্যরঞ্জন বেদম খেপে গিয়ে বললেন, ‘ভয়ের চোটে তোর মাথা খারাপ হয়েছে গবু। দেখ ফের যদি এরকম করবি তো তোকে আমি এইখানেই ফেলে রেখে যাব।’
গবু অনুনয় করে বলল, ‘আজ্ঞে বিশ্বেস করুন, এই কিছুক্ষন আগে অবধি পাদুটো ছিল না। এ-এইমাত্র হল, মানে এইমাত্র আবার দেখতে পেলুম।’
—‘তোর মুন্ডু! যতসব খোয়াব দেখছিস। তোকে বলেছি না কোনটা দেখা উচিত আর কোনটা নয় এ বিষয়ে ভালো করে বিবেচনা করতে। এখন চুপচাপ পিছু পিছু আয়। পাথরগুহা এই কাছাকাছি কোথাও একটা হবে।’
গবু বকুনি খেয়ে মাথা নীচু করে চুপচাপ চলতে লাগল। তার কী দোষ বাবা! পষ্টাপষ্টি দেখা যাচ্ছিল পা দুটো নেই। এখন অস্বীকার করলেই হল নাকি? তাছাড়া ভয়ের চোটে নিতান্তই যদি খোয়াব দেখে থাকে তো সে আর এমন কি? হাঁটতে হাঁটতে যদি পেছন ফিরে দেখা যায় পেছনের রাস্তা নিঃশব্দে মুছে গিয়ে সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে তবে ভয় না পেয়ে উপায় কী?
আলো বেশ কমে এসেছে। আশপাশ কেমন নিঝুম। গবু লক্ষ্য করল আর পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে না। সুর্মানালার কাছে তবু দু একটা ময়ুর চোখে পড়েছিল, এখন সে সব ও নেই। সব যেন কেমন দম বন্ধ করে একটা কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে।
আরো বেশ কিছুটা যাবার পর হঠাৎ সত্যরঞ্জন হুররে বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। গবু তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে দেখল বনের মাঝখানে একটা নিচু জলা, তার বাঁদিক ঘেঁসে বেশ বড় খানিকটা উঁচু ঢিবি। গাছপালায় ঢাকা বলে চট করে ঠাহর হয় না। আশেপাশে বুনোলতাপাতা একটু কম। ঢিবির ভেতর একটা গুহা মতন। সামনে পাথর দিয়ে খিলান মত করা। আর তার সামনে সত্যরঞ্জন কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছেন। চারিদিক কি স্যাঁতসেঁতে। গবুর শীত করতে লাগল।
—‘মার দিয়া কেল্লা! বুঝলি। আশা করি এতটা যখন আসা গেছে তখন আর খালি হাতে ফিরতে হবে না। বেশ বড়সড় দাঁও মারা যাবে কি বলিস। উহ কি আনন্দ!’ সত্যরঞ্জন হাত পা তুলে নাচতে লাগলেন।
তবে কম আনন্দের ব্যাপারটা ঘটল এর পরেই। গবু দেখল সত্যরঞ্জনের কথাটা শেষ হওয়া মাত্র মুহূর্তের মধ্যে ওনার নীচ থেকে কোমর পর্যন্ত অদৃশ্য হয়ে গেল। অথচ সত্যরঞ্জনের দেহের উর্দ্ধাংশটুকু দিব্যি দেখা যাচ্ছে। গবু পরিস্কার চোখে দেখল উপরের অংশটা পাথরগুহার মুখে উঁকি ঝুঁকি মারছে। অথচ কোমরের নীচ থেকে বাকিটা নেই। গবু প্রথমে হতবাক হয়ে চেয়ে রইল ওই অশৈলী কান্ডের দিকে তারপর চীৎকার করে হাত পা ছুঁড়ে শ্যাওলামাখা জমির উপর জ্ঞান হারিয়ে একেবারে চিতপাত। সত্যরঞ্জন তাড়াতাড়ি ছুটে এসে দেখলেন গবুর দাঁতে দাঁতকপাটি লেগে গেছে।
কোনোরকমে চোয়াল চেপে ধরে দাঁতকপাটি ছাড়ানো গেল। বেচারা এখনো গোঁ গোঁ করছে। সত্যরঞ্জন জলা থেকে আঁজলা ভরে নোংরা জল তুলে এনে গবুর মুখে চোখে ছিটিয়ে দিলেন। বিচ্ছিরি দুর্গন্ধের চোটে গবু ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।
—‘কি ব্যাপার কি শুনি? ওরকম হাঁউমাউ করে চীৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলি কেন?’
গবু আধবোজা চোখে সত্যরঞ্জনকে দেখতে লাগল। কোমরের নীচের অংশটা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে যেন। একটু সাহস ফিরে পেয়ে গবু কোনওমতে উঠে বসল। আস্তে আস্তে সত্যরঞ্জনের ধুতি সমেত হাঁটু জুতো মোজা ইত্যাদি ফুটে উঠছে। সেদিকে চেয়ে থেকে শুকনো গলায় গবু বলল, ‘বার বার অমন উবে যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে কেন বলুন তো?’
সত্যরঞ্জন রেগেমেগে বললেন, ‘ফের ওইসব বাজে কথা। অনেক্ষন খাসনি কিছু তাই অমন হচ্ছে। মনকে শক্ত কর। সামনে অনেক কাজ।’
ইতোমধ্যে পুরো অংশটাই ফুটে উঠেছে। গবু একবার জুতোয় হাত দিয়ে পরখ করে দেখল। হ্যাঁ বেবাক সত্যিকারের বলেই তো মনে হচ্ছে।
সত্যরঞ্জন ভীষন বিরক্ত হয়ে একটা বড় গোলমতো পাথরের উপর বসে পড়ে ম্যাপটা খুলে ধরলেন। ম্যাপের নির্দেশ আগের মতোই সহজ। সোজা লম্বা গুহাটার শেষপ্রান্তে যেতে হবে। তারপরেই ফকির থেকে তিনি রাজা উজির বনে যাবেন। তখন তাঁকে আর পায় কে।
এদিকে আধশোয়া হয়ে বসে গবু একমনে তাঁকে লক্ষ্য করতে লাগল। বারবার দুবার এরকম হল। শেষমেশ সত্যই সে খোয়াব দেখছে নাকি? কিন্তু তা কী করে হবে? দ্বিতীয়বার তো রীতিমতো নিজেকে চিমটি অবধি কেটে দেখেছে। এই তো হাতের লাল দাগ তার সাক্ষী। তাহলে সত্যরঞ্জন অমন মাঝে মাঝে উবে যাচ্ছেন কেন?
ধাঁধাঁর কোনো কুল কিনারা না পেয়ে গবু হতাশ হয়ে পাথরগুহার দিকে তাকিয়ে রইল। ভয়ের চোটে রীতিমতো ঘেমে চান করে গেছে সে। ছুটে যে পালাবে তার উপায় নেই, যে রাস্তায় এসেছে সে রাস্তা কখন মুছে গেছে। ম্যাপে বেরোবার উপায় লেখা আছে বটে কিন্তু সত্যরঞ্জন এতদুর অবধি এসে কি আর শেষ না দেখে যাবেন। অবশ্য গোয়েন্দা হতে গেলে রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা থাকা ভাল। ওতে নাকি গোয়েন্দারা পোক্ত হয়, সাহস বাড়ে। তখন চোরাগলির মধ্যে বন্দুক হাতে যত ছিঁচকে দের পেছনে ধাওয়া করা মামুলি কাজের মতো হয়ে যায়। তাছাড়া এর থেকেও ভয়ংকর সমস্ত ব্যাপার তো ঘটতেই পারে। সেই যে চোরাকুঠুরিতে সব বন্দী থাকে, আর ছাদে রাতবিরেতে কাদের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, তারপর কালো রঙের ছানাবেড়ালের ল্যাজ— যাক গে সে সব কথা। মোটকথা ভয় পেলে চলবে না।
গবু একটু একটু করে সাহস ফিরে পাচ্ছিল। দিব্যি সহজ সরল লাগছে সব। যেখানে রাতারাতি বনবাদাড় সব কেমন পালটে পালটে যায় সেখানে এমন ঘটনা তো ঘটবেই। ধড় মাথা সব উবে যাচ্ছে তো যাক না, আবার ফিরেও তো আসছে।
ঢং করে ঘন্টা বেজে উঠল। এবার খুব কাছ থেকে। পাথরগুহার ভেতর থেকে কী? গবুর পিলে চমকে উঠল। থেকে থেকে এমন ঘন্টা বাজানোর মানে কী বাপু? এসব শুনলেই ইস্কুলের টিপিনের কথা মনে পড়ে যায়। সেই যে লোহার গেটের তলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে হজমি গুলি আর ঘুগনি কেনা। উফফ সে সবের কী স্বাদ ছিল। এখন সে সব মনে পড়তেই তার বেজায় খিদে খিদে পেয়ে গেল। গরম ভাতের সাথে একটু ঘি, বড়িভাজা, চাকা চাকা করে কাটা আলুভাজা কিংবা উচ্ছে। তারপর গরমাগরম ছোলার ডাল দিয়ে চাট্টিখানি ভাত মেখেই মাছের ঝোলের বাটির দিকে হাত বাড়ানো। সে সব শেষ হলে আমসত্ত্বর চাটনী আর পাঁপড় দিয়ে পুন্যকাজে ইতি। উলস। ভাবতে ভাবতে গবুর চোখ বুজে এল। জিভে জল। পেটের ভেতর কেমন যেন খুন্তিমোচড় দিয়ে উঠল। খিদের কী জ্বালা রে বাপ।
সত্যরঞ্জন মনোযোগ সহকারে ম্যাপ দেখছিলেন। লাল রঙের গোলের ভেতর যেখানে পাথরগুহার হদিস দেওয়া আছে তার পাশে ঢেঁড়া দিয়ে লেখা ‘সাবধান’। কী থেকে সাবধান হতে বলছে? চারপাশে যা সব অদ্ভুতুড়ে কান্ডকারখানা ঘটছে তার থেকেও সাংঘাতিক কিছু? কে তার হদিশ দেবে? তার উপর গবুটাও থেকে থেকে ওমন দাঁত ছিরকুটে পড়ছে কেন কে জানে?
গবুর কথা খেয়াল হতেই মুখ তুলে তাকিয়ে সত্যরঞ্জন আঁক করে লাফিয়ে উঠলেন। কারন আর কিছুই নয়, পরিস্কার দিনের আলোয় তিনি দেখতে পেলেন গবুর মুন্ডুটা শুন্যে ভাসছে। ধড়টা বেবাক লোপাট। একলাফ দিয়ে পাথরের পেছনে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে উঁকি মেরে তিনি মুন্ডু টাকে লক্ষ্য করতে লাগলেন। একটু আগে গবু যা বলছিল তা তবে সত্যি। কোনোরকমে চিঁ চিঁ করে সত্যরঞ্জন বলে উঠলেন, ‘এ-এই গবু, এই হ-হতভাগা।’
মুন্ডুটা প্রথমে ঘাড় ঘুড়িয়ে ওঁকে এদিক ওদিক খুঁজল, তারপর বিনীত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘আজ্ঞে আপনি কোথায়?’
—‘ইয়ে, পা-পাথরের পে-পেছনে!’
মুন্ডুটা একটু শুন্যে উঠল তারপর এগিয়ে আসতে লাগল।
—‘অ্যাই খবরদার এগোবি না!’
মুন্ডুটা থেমে গেল ওখানেই। প্রশ্ন করল, ‘কেন কি হল?’
—‘ইয়ে, তোর ধড়টা কই, খালি মুন্ডুটা দেখতে পাচ্ছি যে।’
গবু চোখ বড়বড় করে বলল, ‘দেখেছেন, আমিও তখন ঠিক এমনি দেখেছিলাম। তখন তো পেত্যয় হয় নি। এইবার দেখুন।’
সত্যরঞ্জন দেখলেন কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে আবার গবুর মাথার নীচে ধড় গজাচ্ছে। হাত পা, লাল ফতুয়া, সব কেমন ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। কিছুক্ষন পর দিব্যি পুরোটাই আবার যেমনটি ছিল তেমনটি হয়ে গেল। সত্যরঞ্জন পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।
—‘ওরে গবু, ওরে অলুক্ষুনে এ কী দেখলুম রে বাপ!’
গবু স্বান্তনার স্বরে বলতে লাগল, ‘কিচ্ছু ভাববেন না, মুছে দেবার পর সব যখন আবার ফিরিয়ে দিচ্ছে তখন ভয়ের কিছু নেই।’
—‘কিন্তু এ সব কেন হচ্ছে বলত। নকশাতে তো এরকম কিছু বলা নেই।’
গবু চিন্তিত মুখে বলল, ‘আজ্ঞে আমিও তো রকম সকম কিছু বুঝছি না। আহা দিব্যি বসে বসে ডালভাতের খোয়াব দেখছিলুম।’
সত্যরঞ্জন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অন্ধকার হয়ে এসেছে। এরপরেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসবে। তখন আরো কি কি সব মাদারীর খেলা শুরু হবে কে জানে। নকশাতে সাবধান বলতে কি এইসবই বোঝানো হয়েছে?
গবু পাথরগুহার সামনে গিয়ে একবার উঁকি ঝুঁকি মেরে এলো। ভেতর টা প্রায় অন্ধকার। যদিও কোথা থেকে যেন আবছা আলো আসছে। ক্ষীন অদ্ভুত আওয়াজ ও একটা শোনা যাচ্ছে যেন। শব্দটার রকমফের বোঝা যাচ্ছে না। ভেতরে জন্তু জানোয়ার কিছু আছে নাকি? নাকি কালকের মতো ওই রকম ভুতুড়ে মার্কা কিছু। গবুর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
সত্যরঞ্জন কখন গুটিগুটি পায়ে গুহার মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন। শব্দটা তিনিও শুনেছেন। এ আবার কী নতুন বিপদ কে জানে? দুজনে মিলে একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।
—‘ইয়ে ভেতরে কি যেতেই হবে?’
—‘উপায় নেই। এখান থেকে বেরোতে গেলে গুহার ভেতর ঢুকতেই হবে, ম্যাপে সেরকমই বলা আছে।’
—‘কিন্তু শব্দটা?’
—‘আর ভেবে কি হবে? চল, যা আছে কপালে।’
গুহার মধ্যে পা রাখতেই বাইরে যেন প্রলয় ঘটে গেল। গবু আর সত্যরঞ্জন দুজনেই বুঝলেন পিছনের দৃশ্যপট ওলটপালট হয়ে গেল। ঐ শ্যাওলা মাখা স্যাঁতস্যেঁতে জমি, জলার পাশে বাঁশগাছের সারি, এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা ছোট বড় গোল গোল পাথর সেসব হয়তো এখন আর নেই। বদলে হয়তো বিশাল বড় একটা দিঘীই তৈরী হয়েছে, কিংবা হয়তো চারপাশে বড় গাছে ঘেরা কোন মাঠ, অথবা আরো অন্য অলৌকিক কিছু। ভয়ের চোটে সাহস হল না পেছন ফিরে দেখার। কাঁপতে কাঁপতে দুজনে মিলে গুহার ভেতর ঢুকে পড়লেন।
অপ্রশস্ত গুহা। পাশাপাশি দুজনে মিলে হাঁটা যায় না। পাথরের দেওয়াল। গুহার মেঝেও চৌকো চৌকো পাথর পাশাপাশি বসিয়ে তৈরী। দেওয়ালের ফাঁকফোঁকর থেকে গাছের শিকড়বাকড় বেরিয়ে নানান অদ্ভুত রকম নকশা তৈরী হয়েছে। তার মাঝে মাঝে অদ্ভুত ভাষায় খোদাই করে কি সব লেখা। কিছু কিছু জায়গায় ছবিও আছে। অবশ্য দেখে বোঝাই যাচ্ছে বেশিরভাগই অপটু হাতের খোদাই। মানুষ না জন্তু জানোয়ার বোঝার উপায় নেই। কয়েক জায়গায় তো চোখমুখ রীতিমতো টেরাবেঁকা। কে আবার তার উপর ছেলেমানুষী করে ল্যাজও এঁকেছে।
লম্বা গুহাটা মাঝে মাঝে এঁকেবেঁকে গেছে। তবে কোথাও কোন শাখা প্রশাখা নেই। এক অদ্ভুত রকম নীলচে আলোয় ঢেকে আছে পুরো গুহাটা। এরকম আলো সত্যরঞ্জন কখনো দেখেননি। দেখে মনে হচ্ছে যেন আলোটা এক্ষুনি হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে ফেলা যায়। সেই আলোতে মাঝে মাঝে নকশাটা খুলে মিলিয়ে দেখছিলেন তিনি। যদিও বিশেষ কিছু দেখার নেই, জলের মতো সহজ পথনির্দেশ। অবশ্য ম্যাপে এই শব্দটার ব্যাপারে কিছু বলা নেই।
আরো একটা বাঁক নেওয়ার পর শব্দটা বেশ জোরালো হল আর সেই সঙ্গে পিলে চমকানো ঘন্টার আওয়াজ। সত্যরঞ্জনের মনে হল গুহার প্রায় শেষের কাছাকাছি পৌঁছেছেন। সামনে হয়ত কোন বড়সড় ঘর মতো আছে, আর তার মধ্যেই হয়ত সেই সব চোখ জুড়োনো আহ্লাদী জিনিসপত্তর। আলোর তীব্রতা বেড়েছে। গুহার দেওয়ালের নকশা গুলো এই আলোতে আরও পরিস্কার।
‘এই যে! এই যে! আবার সেরকম হচ্ছে।’ গবু ফিসফিসিয়ে উঠল।
সত্যরঞ্জন ঘাবড়ে গেলেন। আবার অদৃশ্য হচ্ছেন নাকি?
—‘গোড়ালি...না না হাঁটু অবধি উবে গেছে যে!’
‘অ্যাঁ, বলিস কী’, সত্যরঞ্জন দরদর করে ঘামছেন। এ কি গেরো রে বাবা।
—‘দাঁড়ান, দাঁড়ান, আবার সব ফেরত আসছে!’
—‘আসছে?’
—‘তাই তো দেখছি।’
—‘যাক বাবা। ফেরত এলেই বাঁচি। একবার খালি ওই হীরে মাণিক হাতে পাই তারপর এমুখো আর কখনো হব ভেবেছিস?’
—‘কী আশ্চর্য! এই দেখুন আবার কোমর অবধি উবে গেল।’
সত্যরঞ্জনের এবার কেমন সন্দেহ হল। তিনি ভুরু কুঁচকে ভাবতে লাগলেন। গা হাত পা উবে যাওয়ার সাথে সাথে কিছু একটার সম্পর্ক আছে বলে মনে হচ্ছে। যা ভাবছেন তাই কী ঠিক? চেষ্টা করে আবার দেখা যাক।
—‘ওরে, এখন কেমন বুঝছিস?’
—‘ইয়ে, যেমন হয় আবার আস্তে আস্তে সব ফুটে উঠছে।’
সত্যরঞ্জন কোমর, পা, ছেঁড়া ধুতি, জুতো মোজা সব ফেরত আসা পর্যন্ত চোখ বন্ধ করে রইলেন। তারপর ফিসফিসিয়ে গবু কে বললেন, ‘আচ্ছা, এবার দেখ তো আবার সব অদৃশ্য হচ্ছে কি না।’
এই বলে একমনে চোখ বন্ধ করে গুহার ভেতর সাত রাজার ধনের কথা ভাবতে লাগলেন। মোহর ঠিক কতগুলো আছে ভেতরে? আশা করা যাক সবকটাই একদম খাঁটি সোনা। অবশ্য এদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকাও বিচিত্র নয়। যা দাম পাওয়া যাবে তাতে হেসে খেলে বাজার চকের মাঝখানে সবচেয়ে বড় একখানা এজেন্সি খুলতে আর কতক্ষন। সত্যরঞ্জনের সত্যসন্ধান। আহা ভেবেও সুখ, একেবারে যাকে বলে তূরীয় অবস্থা।
‘ইয়ে, মাথার চুল ছাড়া আর কিছুই তো নেই দেখছি’, গবু ধরা গলার বলে উঠল।
সম্বিত ফিরে পেয়ে সত্যরঞ্জন চোখ খুলে অবস্থাটা পর্যালোচনা করলেন। এক্সপেরিমেন্ট একটু বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে গেছে মনে হচ্ছে।
—‘আচ্ছা বেশ, এবার দেখা যাক কী হয়।’
সত্যরঞ্জন ফের চোখ বন্ধ করে এবার স্ত্রী সৌদামিনীর মুখঝামটার কথা ভাবতে লাগলেন। ইস, কথার তেজ আছে বটে। হবে নাই বা কেন? পূর্বপুরুষ এককালে ডাকাত ছিল তো। ছোড়দাদু বারন করেছিল বটে, ‘সত্য অমন মেয়ে বে করিসনি বাপ’। আবার পিসেমশাইটিও কম ধুরন্ধর নন। কালীগঞ্জের দাশু শ্যামাপদর সাথে মামলা মোকদ্দমা করে পেড়ে উঠত নাকী। নেহাত ঐ পিসেমশাই রাঘব পোড়েল দাশুর উকিল ছিলেন, তাই না অমন সাংঘাতিক ভাবে হারা কেস দাশু জিতে যায়। এমনকি শ্যামাপদর নামে পালটা ফৌজদারী মামলা অবধি ঠোকা হয়েছিল। যদিও বছর ঘুরতে না ঘুরতে সেসব সামলে ফের শ্যামাপদই শেষ হাসি হাসে। এবার অবশ্য রাঘববাবু শ্যামাপদর সাথে ছিলেন। ফলতঃ দাশু এখন শহরে জেলের ঘানি ঠেলছে।
—‘আসছে আসছে, সব আবার যেমনকে তেমন হচ্ছে। মায় চুলের ছাঁটটুকু অবধি ঠিক রেখেছে!’
সত্যরঞ্জন চোখ খুলে কাষ্টহাসি হেসে বললেন, ‘বুঝলি?’
—‘ইয়ে না তো!’
—‘খুব সহজ। আসল ব্যাপার হল লোভ। যেই লোভ করবি অমনি হাপিশ হতে আরম্ভ করবি। উলটো ভাবলেই ফেরত।’
‘বলেন কী। কী সর্বনাশ!’ গবুর চুল খাড়া খাড়া হয়ে উঠল।
—‘শ স স স। সর্বনাশের কিছু নেই, খালি লোভ না করলেই চলবে। এইটাই আসল ফাঁদ বুঝেছিস। এখন পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে বনের ভেতর যারা ঢোকে তাদের কে আর খুঁজে পাওয়া যায় না কেন?’
—‘কেন কেন?’
—‘যারা বনের ভেতর ধনরত্নের খোঁজে আসে তারা একাএকাই আসে। কাউকে সাথে নিয়ে আসে না। পাছে ভাগ দিতে হয়। এদিকে লোভের চোটে তারা নিজেরা বুঝতেই পারে না কখন তারা উবে যায়, তাই আর কেউ দেখতেও পায় না। একবার পুরোপুরি উবে গেলে হয়তো কিছু করেই আর ফিরে আসা যায় না।’
গবু ভেবে দেখল কথাটায় যুক্তি আছে। একটু আগে সে যখন প্রায় মিলিয়ে যাচ্ছিল তখন তার ভালমন্দ খেতে ইচ্ছে করছিল বটে। কিন্তু তাহলে ওইসব মোহর ইত্যাদি হাতে পেলে কী হবে? লোভ না করে থাকা যাবে নাকি?
একথা বলতেই সত্যরঞ্জন গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘কিছু একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে। আপাতত গুপ্তধনের কথা মাথাতেও আনিস না। বদলে সাত্তিক কিছু ভাব।’
—‘কি রকম?’
‘আহ। ভাব তীর্থে যাচ্ছিস। এখন কথা না বাড়িয়ে পিছু পিছু আয়।’ সত্যরঞ্জন খেঁকিয়ে উঠলেন।
গবু কথা না বাড়িয়ে সত্যঞ্জনের পেছন পেছন চলতে লাগল। তীর্থে যাচ্ছি এসব ভাবা কী সোজা নাকি।
এদিকে শব্দটা ক্রমশ বাড়ছে। একটানা নয়, মাঝে মাঝে কমছ বাড়ছে। আলোও বেশ বেড়েছে। গুহা এখানে একটু চওড়া। গুহার দেওয়াল জুড়ে আঁকা ছবি গুলো ওই অদ্ভুত নীলচে আলোয় যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। অদ্ভুত রকম সব ছবি। মাঝে মাঝেই গোল চ্যাপ্টা মতন কিছু একটার ছবি আঁকা। তার ভেতর থেকে ল্যাজওলা, কুলোর মত কান গোরিলাদের মতন দেখতে কি সব যেন বেরোচ্ছে। কোথাও ঐ গোরিলার পাশাপাশি মানুষের ছবি আঁকা। নীচে অদ্ভুত হরফে কি সব লেখা।
আবার ঘন্টা বেজে উঠল, এবার এত জোরে যে কানের পর্দা প্রায় ফেটে যাবার জোগাড়। গবু কান চেপে ধরে বসে পড়ল। সত্যরঞ্জনও দাঁড়িয়ে পড়েছেন। ঘন্টার গৎ এর রেশ গুহার দেওয়ালে প্রতিধ্বনি হচ্ছে।
সামনে একটা বড় পাথরের দেওয়াল। পাথর কেটে দরজা মতন করা।
ওই দেওয়ালের হদিশ নকশায় দেওয়া আছে। শেষ দেওয়াল পাশে ঢেঁরা কাটা।
ঘন্টার শব্দের রেশ কমে এসেছে।
তবে অন্য শব্দটা বেড়েছে। কেমন ঘড় ঘড় আওয়াজ।
সত্যরঞ্জন থমকে দাঁড়ালেন। ওই দেওয়ালের পেছনেই যদি গুহ্য বস্তু সব থাকে তাহলে আগে থেকে তৈরী থাকা দরকার। তাঁকে থামতে দেখে গবুও দাঁড়িয়ে পড়ল।
ভীষন কিছু একটা ভাবা দরকার। স্ত্রী সৌদামিনীর মুখটা ভেসে উঠল। সত্যরঞ্জন মহাখুসি হয়ে গবুকে বললেন, ‘অন্য কিছু ভাবতে থাক। তবে খবরদার গুপ্তধনের কথা ভাববি না।’
গবু অন্য কিছু না পেয়ে ঘোষেদের গোয়ালের সেই ভয়ানক গোরুদের কথা ভাবতে লাগল। বিশেষ করে সেইটার কথা যার শিঙের গুঁতোয়—
‘ওই দ্যাখ!’, সত্যরঞ্জন পাথরের দেওয়ালের দরজা দিয়ে উঁকি মেরে উত্তেজনায় গবুর জামা খামছে ধরেছেন। অবশ্য হাত দিয়ে ধরেছেন কিনা বোঝার উপায় নেই। কারন ওনার মুন্ডু বাদে বাকি সব কিছুই উবে গেছে। গবুর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
দরজার ধার এসে উঁকি মেরে গবু দেখল ওধারে একটা বেশ বড় ঘর। পুরোটা নীলচে আলোয় ছেয়ে গেছে। সেই অদ্ভুত আলোর উৎস হল একটা বালিঘড়ি। ঘরের মাঝখানে সেটা শুন্যে ভেসে আছে! গবু একবার নিজের চোখ কচলে নিল। হ্যাঁ, নিয্যস বালিঘড়িখানা শুন্যেই ভেসে আছে বটে। ঘড়ির উপরের খোপখানা নীলরঙের, নীচের খোপের রঙ হাল্কা গোলাপী। উপরের খোপের ভেতর কেমন সাদা গুঁড়ো মতন রয়েছে। সেই গুঁড়ো ধীরে ধীরে নীচের খোপে ঝরে পড়ছে। গবু ভীষন রকম অবাক হয়ে গেল।
অবশ্য অবাক হওয়া তখনো বাকি ছিল। শুন্যে যেখানে ঘড়িটা ভেসে আছে তার পাশেই মেঝের উপর একখানা চটের বস্তা রাখা। আর সেই বস্তার ওপর—
রাশি রাশি সোনার মোহর! নীল রঙের আলোয় সে সব কেমন ঘোর লাগিয়ে দেয়। এত মোহর! এক একটা অন্তত হাতের তালুর মতন সাইজ। উপরে কি সব লেখা তা অবশ্য দূর থেকে স্পষ্ট নয়। কিন্তু তাতে কি? এক্ষুনি ছুটে গিয়ে সব হাতিয়ে নিলেই তো হয়।
ইচ্ছেটা মনে হতেই দ্রুত নিজেকে সামলাল সে। নাহ গরু গুলোর ব্যাপারে ভাবতেই হচ্ছে। তড়িঘড়ি পিছিয়ে এসে সে সত্যরঞ্জনের দিকে তাকাল। মাথার ব্রক্ষ্মতালুর শেষটুকু ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। উনি বোধহয় এখনো মোহরের দিকে চেয়ে আছেন। আন্দাজে সে জামা ধরে এক হ্যাঁচকায় তাঁকে সরিয়ে আনল।
ফের নিজের চেহারা ফিরে পেতে সত্যরঞ্জনের সময় লাগল ঝাড়া পাঁচমিনিট। পকেট থেকে রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছে টুছে তিনি বললেন, ‘বাপস! চোখে অন্ধকার দেখছিলাম। ভাগ্যিস তুই ছিলি।’
—‘এবার কী করবেন?’
—‘শ স স স!’
পাশের ঘরের ঘড় ঘড় শব্দটা থেমেছে। মনে হল কেউ যেন হাই তুলল। সত্যরঞ্জন আর গবু তাড়াতাড়ি একটু আড়াল খুঁজে সরে এলেন। দরজা দিয়ে কেউ বেরোলে চট করে তাঁদের দেখতে পাবে না।
ঘরের ভেতর কার যেন পায়ের আওয়াজ।
ওঁদের হৃদকম্প হতে লাগল। ঘরের ভেতর কী আছে কে জানে?
পায়ের আওয়াজটা এবার দরজার দিকে এগিয়ে আসছে।
ভয়ের চোটে গা হাত পা বরফের মতো ঠান্ডা। গবু একবার অজ্ঞান হবে নাকি?
পায়ের আওয়াজ দরজার ওপাশে।
ঠিক এমন সময় কান ফাটিয়ে ফের ঘন্টার আওয়াজ ভেসে এল। সত্যরঞ্জনের দাঁতে দাঁতকপাটি লাগার যোগাড়। গবু ভয়ের চোটে তাঁর কাঁধ এমনভাবে খিমচে ধরেছে যে নুনছাল উঠে গিয়ে জ্বালাজ্বালা করছে।
ঘরের ভেতর থেকে জগা পাগলা বেরিয়ে এল।
প্রথম চোটে সত্যরঞ্জন এতটাই অবাক হয়ে গেলেন যে ভীষন রকম তোতলাতে লাগলেন। গবুও চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে থাকল।
জগা পাগলা দরজার বাইরে বেরিয়ে ওঁদের দেখতে পেয়ে হাই তুলে একগাল হেসে এগিয়ে এলো।
সত্যরঞ্জন এবার হাঁউমাউ করে উঠলেন, ‘এই এই ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।’
—‘হি হি। এই যে কালীবাবু, কুকুরছানা নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছেন বুঝি?’
গবুর পিত্তি জ্বলে গেল। ছোটোলোক কোথাকার।
—‘তুই এখানে?’
—‘হি হি। তা এখানে কিন্তু বেল গাছ পাবেন না সেই বকুলতলায় যেতে হবে।’
ব্যাটা বদ্ধ উন্মাদ, সত্যরঞ্জন ভাবলেন। যাইহোক আপাতত ঘরের ভেতরে গিয়ে একবার সরেজমিনে তদন্ত করে আসতে হবে। বালিঘড়ির ব্যাপারটাই বা কী? ওটা শুন্যেই বা ঝুলে কেন?
জগাপাগলা কে আড়চোখে দেখতে দেখতে দুজনে মিলে ঘরের ভেতর সাবধানে ঢুকলেন। আর অমনি ঘন্টার গৎএর রেশ মিলিয়ে গেল। ঘরের মাঝখানে বালিঘড়িটা এখনো শুন্যে ভাসছে। আর তার পাশে জ্বলজ্বল করেছে মোহরগুলো। বেশীক্ষন তাকালে কেমন ঝিম ধরে যায়। এই তাহলে গোবিন্দখুড়োর সাতরাজার ধন মানিক।
সত্যরঞ্জনের মনে হল ওদিকে বেশী না তাকানোই উচিত। মোহরের চেয়ে তাঁর নিজের নধর দেহ খানা তাঁর কাছে অনেক বেশী প্রিয়। দাঁতে দাঁত চেপে অন্যদিকে তাকিয়ে তিনি ট্যাঁক থেকে ম্যাপখানা বার করলেন। গবু হাঁ করে ঘরের দেওয়ালে আঁকা ছবি দেখতে লাগল। এখানকার ছবিগুলো অন্যরকম। রঙ দিয়ে আঁকা। সেই গোরিলাদের ছবিই বটে তবে কেমন যেন যুদ্ধ যুদ্ধ মনে হচ্ছে। একদল তাড়া করছে, একদল পালাচ্ছে, একদল মাটিতে পড়ে রয়েছে। অনেক গোল গোল চ্যাপ্টা পিঠের মতো জিনিসও আঁকা। একজায়গায় দেখল ঘড়ির ছবিটাও আঁকা। ঘড়িটার সাথে কি ওই ওইসব গোরিলা গুলোর যোগাযোগ আছে নাকি। সেসব আবার হাজির হবে না তো! কালকে রাতের ভূতটাও বালিঘড়িটার কথা বলছিল না? বালিঘড়িটা আসলে কী? ভূতটা বালিঘড়ি টা চায় কেন? ওটা অমন শুন্যে ঝুলেই বা আছে কি করে। অবশ্য এর আগে যা সব ঘটেছে তারপর এ আর অস্বাভাবিক কি?
এদিকে সত্যরঞ্জন একমনে ম্যাপটা দেখছিলেন। ওতে এরপর কি করতে হবে সে সব কিছু বলা নেই তবে আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে ফেরবার রাস্তাটা শুরু হচ্ছে ঘরের মাঝখান থেকে। কিন্তু ঘরের মাঝখানে তো বেরোনোর কোনো রাস্তা নেই। তাহলে? আর এই ফেরবার রাস্তা এরকম বেখাপ্পা একটা গোলদাগে শেষ হচ্ছে কেন?
‘ঠিকানা মিলিয়ে বাড়ি খুঁজছেন বুঝি? আমাকে বললে সুলুকসন্ধান দিতে পারব, এখানে প্রায়ই আসা যাওয়া করি কিনা, বাব্বাঃ যা ঘুম হয় না’, জগা পাগলা পাশে এসে দঁড়িয়েছে। হাই তুলছে। তাহলে ওইরকম বিচ্ছিরি আওয়াজ করে জগাই নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল।
সত্যরঞ্জন চোখ ছোট করে জগার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, ‘তুই এখানে প্রায়ই আসিস নাকি?’
—‘আজ্ঞে তা তো বটেই। বনের ভেতর নানান মজাদার জিনিস আছে!’
সত্যরঞ্জন বিরক্ত হলেন। গবুকে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘কি করা যায় বল তো। আমি তো বেশীক্ষন লোভ সামলে রাখতে পারব না।’
গবু মাথা চুলকে উত্তর দিল, ‘আজ্ঞে বস্তাটা নিয়ে একছুটে পালালে হয় না?’
—‘গবেট! পালাবার রাস্তাটা কোথায়? যে পথে এসেছিস সে পথ কি আর আছে?’
—‘তাই তো। কিন্তু...কিন্তু তাহলে জগা পাগলা কি করে আসে যায় এখান থেকে?’
দুজনে হাঁ করে একে অপরের মুখের দিকে কিছুক্ষন চেয়ে রইলেন। তারপর খুব করে জগা পাগলার কাছে গিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ সুরু হল। কিন্তু পাগলের কাছ থেকে হদিস পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা! এদিকে মোহরের উপর লোভ লালসাও কেমন চিড়বিড়িয়ে উঠছে। ওগুলো প্রায় চুম্বকের মতো টানছে। এ সব সামলানোর জন্য সত্যরঞ্জন আরো বেশী বেশী করে সৌদামিনীর কথা ভাবতে লাগলেন। পুরোনো নতুন গালমন্দ মুখঝামটা সব হুড়মুড়িয়ে মনে পড়তে লাগল।
গবু এর আগে গল্পে পড়েছে কেমন করে সব মোহরের লোভে যখ হয়ে বসে থাকে। সে সব যে নেহাত মিথ্যে নয় এইবার সে হাড়ে হাড়ে বুঝতে লাগল। চটের বস্তাটার ওপর রাশি রাশি মোহর কেমন এলিয়ে পড়ে রয়েছে। নীলচে রঙ তার উপর পড়ে মাঝে মাঝে ঠিকরে উঠছে যেন। ওর কয়েকটা পেলেই সে বড়লোক। জীবনে আর খাওয়া পরার চিন্তা থাকবে না।
ভাবনা থামিয়ে হঠাৎ গবুর মনে হল, এই এতক্ষন যে দিব্যি মোহরের চিন্তায় মশগুল ছিল, হাত পা মায় গোটা দেহটাই মুছে যায়নি তো। জগাপাগলার মতো হলে বেশ হত। পাগল তো তাই মোহর গুলোর মানে বুঝছে না। আর তাই উবে যাওয়ার ভয়ও নেই।
কোনোমতে মোহরের উপর থেকে চোখ সরিয়ে সত্যরঞ্জনের দিকে তাকাতেই সে দেখতে পেল তিনি কোনোমতে দুহাত দিয়ে চোখ ঢেকে দাঁত মুখ খিঁচিঁয়ে আড়ষ্ট ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। গবু কাছে গিয়ে একটু ঠেলা দিল। সত্যরঞ্জন ওই অবস্থাতেই বললেন, ‘তাড়াতাড়ি মোহর গুলো ওই চটের বস্তায় বাঁধ।’
—‘কিন্তু ইয়ে লোভ সামলাভ কি করে? এই আপনার মতো দুচোখ ঢেকে—’
—‘ওরে গবেট চোখ ঢাকলে দেখবি কি করে? লোভ সামলা, লোভ সামলা। শুধু মোহর কেন, যে কোন লোভকেই এখন সামলে সুমলে রাখ। ভাব ওগুলো মোহর নয়, ইয়ে কি বলে, ওগুলো হচ্ছে...আলু’
—‘আলু!’
—‘হ্যাঁ হ্যাঁ আলু। কেন কি হয়েছে কি তাতে?’
গবু কথা না বাড়িয়ে ধীর পায়ে সাবধানে মোহরের দিকে এগিয়ে গেল। জলজ্যান্ত মোহরগুলো কে আলু ভাবা কি চাট্টিখানি ব্যাপার। তাছাড়া মোহরের কাছে যেতেই কি ভয় করছে। কোথা থেকে আবার নতুন করে কি অশৈলী কান্ড শুরু হয়, কে জানে। অবশ্য মোহরের বস্তাটার কাছে পৌঁছে গবু দেখল নতুন করে কোথাও কিছু হল না। সত্যরঞ্জনও ঠায় চোখ বন্ধ করে আছেন। বালিঘড়িটাও যথারীতি শুন্যে ভাসছে। আর ঘরের এককোনে দাঁড়িয়ে জগা পাগলাও তাকে নিবিষ্ট মনে লক্ষ্য করে চলেছে। তার ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি।
মোহরগুলো একএকটা বেশ ভারী। ওপরে কোনো রাজা বাদশার ছবি আঁকা। উলটো পিঠে শিলমোহরের ছাপ। হয়ত কোনো আদ্যিকালের রাজার টাঁকশাল থেকে চুরি করা। সবকটা মোহরই একরকম। গবুকে মোহরগুলো বস্তাবন্দী করতে দেখে, জগা পাগলাও এগিয়ে এসে হাত লাগাল।
—‘কচি পটল গুলো বেশ সরেস কি বলেন?’
—‘তা তো বটেই।’
—‘তবে বাজারচকের কালুর সবজির দোকানের মতো নয়।’
‘তাও ঠিক’, গবু জগা পাগলা কে আমল না দিয়ে মোহরগুলোকে বস্তায় ভরতে লাগল।
সত্যরঞ্জন চেঁচিয়ে বললেন, ‘ওর সাথে বকবক করিসনি। জলদি কর, আমার পায়ের তলায় মাটিটা কেমন কাঁপছে।’
গবুও টের পেল তার পায়ের তলায় মৃদু কম্পন। দ্রুত মোহর বস্তাবন্দী করার পর সে হাঁফ ছেড়ে উঠল।
—‘হয়ে গেছে।’
সত্যরঞ্জন বলে উঠলেন, ‘ওটা শিগগির জগা পাগলার পিঠে চাপা।’
গবু তো ভীষন অবাক। এমনতো কথা ছিল না। জগা পাগলার পিঠ কেন, তার নিজের পিঠ কি দোষ করল।
—‘আহ যা বলছি কর। ওর পিঠে মোহর গুলো থাকলে আমরা নিরাপদে থাকব। এখান থেকে বেরোবার সময় আবার কী বিপদ হয় কে জানে! ওসব নিজেদের কাছে না রাখাই ভালো।’
গবু ভারী বস্তাটা জগার ঘাড়ে চাপাতেই সে দিব্যি মুঠো করে ধরল। তারপর গম্ভীর মুখে বলে উঠল, ‘লাশ টা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে ঠিক করলেন না মুখুজ্জ্যেমশাই।’
সত্যরঞ্জন চোখ খুলে চীৎকার করে উঠলেন, ‘ওরে মনে হচ্ছে গোটা গুহাটাই ভেঙ্গে পড়বে। শিগগির ওকে হুড়ো দে, তাড়া কর।’
গবু হাঁ করে সত্যরঞ্জনের দিকে চেয়ে রইল। ভয়ের চোটে শেষে কী ওঁর মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল।
‘বুঝতে পারছিস না? জগা হয়ত জানে এখান থেকে কী করে বেরোতে হয়। ওকে তাড়া না করলে ও বেরোবে কেন?’
—‘কিন্তু ওকে সেটা জিজ্ঞাসা করলেই তো হয়।’
‘ওরে বুদ্ধু, ও তো পাগল, ওর কি মাথার ঠিক আছে?’ এই বলে সত্যরঞ্জন জগা পাগলার দিকে তেড়ে গেলেন।
জগা একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল, ‘দেখুন আমি কিন্তু গোপীবাবুর গাছের আম চুরি করি না। তাছাড়া আমার পকেটে আমসত্ত্ব মোটেও নেই।’
—‘গবু!’
গবুকে আর বলতে হল না। সেও একছুটে জগা পাগলার সামনে এসে দাঁড়াল। জগা পেছোতে পেছোতে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। কাঁধের ভারী বস্তাটাকে সে অন্যকাঁধে নিয়ে হেসে বলল, ‘চোরপুলিশ খেলবেন বুঝি!’ তারপর গবুর দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘ওই ওকে তাহলে পুলিশ হতে হবে।’
সত্যরঞ্জন উপায়ন্তর না দেখে বলতে লাগলেন, ‘এই যাঃ যাঃ পালা, হুস হুস।’
উৎসাহী হয়ে গবুও বলতে লাগল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এই পালা পালা, ভাগ, হ্যাট হ্যাট, আঃ চুঃ চুঃ।’
এদিকে কম্পন আরোও বেড়েছে, এবার আর সেটা খালি মেঝে নয়, গোটা পাথরগুহাটাই ভয়ানক ভাবে কাঁপতে লেগেছে। সেসব দেখে সত্যরঞ্জন তুমুল হাত পা ছুড়ে জগা পাগলাকে রাক্ষস খোক্ষসের ভয় দেখাতে লাগলেন। তাতেও কাজ হচ্ছে না দেখে সৌদামিনীর বাছা বাছা বাক্যগুলো শোনাতে লাগলেন। গবুও সুযোগ বুঝে লাফালাফি জুড়ে দিল।
হঠাৎ কী ভেবে জগা গবু আর সত্যরঞ্জনকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে সোজা বালিঘড়িটার দিকে দৌড় লাগালো। পড়ি কি মরি করে ওঁরাও পিছু পিছ ছুট লাগালেন। জগা সোজা বালিঘড়ির তলায় দাঁড়াতেই তীক্ষ্ণ শিসের মত আওয়াজ হল। সেই সঙ্গে কম্পন এত বেড়ে গেল যে মনে হতে লাগল কেউ যেন জামবাটিতে জাম ঝাঁকানোর মত করে পাথরগুহা ঝাঁকাচ্ছে।
সত্যরঞ্জন পরিস্কার বুঝতে পারলেন বেরোতে হলে ঐ বালিঘড়ির তলায় গিয়েই দাঁড়াতে হবে, ম্যাপেও তো তাই লেখা আছে। জগা পাগলার কাছে ম্যাপ না থাকলেও কাকতালীয় ভাবে হয়ত সে রাস্তা খুঁজে পেয়েছে।
আর দেরী না করে গবুকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে কোনরকমে টাল সামলে সত্যরঞ্জন বালিঘড়ীর নিচে ছুটে গিয়ে জগা পাগলার কোমর জাপটে ধরলেন।
কম্পন প্রচন্ড বেড়ে গিয়ে প্রায় উথালপাথাল অবস্থা। মাথার উপর বালিঘড়িটা এখনো একইরকম ভাবে শুন্যে ঝুলে আছে। হঠাৎ জগা পাগলা কি ভেবে বেমালুম ঘড়িটাকে শুন্য থেকে আম পাড়ার মতো করে পেড়ে নিল। সত্যরঞ্জন তা দেখে আঁ আঁ করে চীৎকার করে উঠলেন। কিন্তু ফের তীক্ষ্ণ শিসের আওয়াজে তাঁর স্বর ঢাকা পড়ে গেল।
পায়ের তলা থেকে মাটি সরছে। জ্ঞান হারানোর আগের মুহূর্তে সত্যরঞ্জন শুনতে পেলেন জগা পাগলা বিড়বিড় করে বলছে, ‘ঢাকা খুলনা পুরী পাবনা, ঢাকা খুলনা পুরী পাবনা...’
No comments:
Post a Comment