চন্ডীমন্ডপে ঢোকার মুখে উঁকি মেরে বিশু দেখল কবিরাজমশাই আধশোয়া হয়ে হুঁকো টানছেন। চারপাশে আর কেউ নেই। উনি রোজ সকাল হলে তাঁর ওষুধের বাক্সটি বগলদাবা করে দাওয়ায় এসে বসেন। পসার ভালোই, তবে ইদানীং শহুরে অ্যালোপ্যাথিক আসার পর থেকে একটু মন্দ যাচ্ছে। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। রুগী দেখার অবসরে একটু ফাঁকফোকর পেলে গ্রামের ভালো মন্দের ব্যাপারে মতামত দেন। গ্রামের লোকেরা দরকারে অদরকারে দুচারটে পরামর্শ করতে আসে।
—‘পেন্নাম হই কবরেজমশাই।’
—‘কে? বিশু? বোসো, বোসো। খবর কি?’
—‘আজ্ঞে খবর এমনিতে ভালোই, তবে মাঝে মাঝে শূলবেদনাটা একটু চাগিয়ে উঠছে বলে মনে হচ্ছে যেন।’
কবিরাজমশাই বিশুর নাড়ীটা একটু টিপে দেখলেন। ‘হুঁ, তোমার বায়ু প্রবল হয়েছে, নাড়ীর গতি খানিক বেশী। রোজগারপাতির চেষ্টায় খানিক ক্ষান্ত দাও বাছা।’
—‘আজ্ঞে তা আর কম কি করে করি বলুন। আমি না চাইলেও বিষয়কর্ম যে একেবারে আমার পেছন পেছন ছুটছে।’
—‘বটে। তা এবার কার সর্বনাশ করলি?’
জিভ কেটে ঘাড় নাড়ল বিশু। ‘এ হে হে, কি বলছেন কবরেজমশয়, আমি হলাম গিয়ে ওই কি বলে, কি যেন কথাটা, খবর এদিক থেকে ওদিক করে যে, বাবুলোকেরা বলে, আহাহা পেটে আসছে মুখে আসছে না, কি বেশ যেন, শুনলে মনে হয় ঠুক করে কেউ হাতুড়ি পিটল।’
—‘বার্তাবহ?’
—‘হ্যাঁ, হ্যাঁ ওই, আহাহা কান যেন জুড়িয়ে গেল।’
কবিরাজমশাই গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘তা কী খবর নিয়ে এলি?’
বিশু একটু সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল। ‘খবর অতি গুহ্য কবরেজমশয়। গগনবাবুর চাকর ঝিকু মিঞাকে পাওয়া যাচ্ছে না।’
—‘ঝিকু ওই চাকরটা, যে সারক্ষন নস্যি নেয়?’
—‘আজ্ঞে হ্যাঁ সেই।’
—‘অ্যাঁ, বলিস কি? কখন থেকে?’
—‘আজ্ঞে কাল সন্ধ্যে থেকে।’
—‘তুই জানলি কি করে?’
—‘আজ্ঞে নিখোঁজ হওয়ার আগে অবধি তো আমিই তো ওর পেছু পেছু যাচ্ছিলাম।’
—‘বটে বটে। তা কোথায় নিখোঁজ হল?’
বিশু একটু দোনোমনো করল। ‘ইয়ে, হরিশরাজার জঙ্গলে।’
‘অ্যাঁ’ কবিরাজমশাই সবেগে সোজা হয়ে উঠে বসলেন। জঙ্গলে ঢুকেছে সন্ধ্যাবেলা। ঝিকুর সাহস তো কম নয়। সাথে আর কেউ ছিল নাকি?
—‘আজ্ঞে না। একাই ছিল।’
কবিরাজমশাই চিন্তিত হলেন। হরিশরাজার জঙ্গল বড় সহজ ব্যাপার নয়। বিশেষত রাতের বেলায়।
—‘তা গগন জানে?’
—‘আজ্ঞে উনি এখনো টের পাননি। তবে শিগগিরিই পাবেন।’
—‘বেশ, আচ্ছা শোন, এখবর যেন এখনি পাঁচকান না হয়।’
—‘আজ্ঞে এই যে আপনি বিধান দিলেন। এই ঠিক রইল।’
—‘আচ্ছা এখন বিদায় হ, আর শোন ওবেলা আসিস, কিছু জড়িবুটি বেটে রাখবখন।’
—‘আর একটা কথা কবরেজমশয়?’
—‘আবার কী?’
—‘ইয়ে, গোবিন্দখুড়ো।’
—‘তার আবার কী হল?’
—‘আজ্ঞে, মানে, জানতে চাইছি আর কি? আচ্ছা উনি কী অপদেবতা?’
কবিরাজমশাই চটে উঠলেন। ‘হারামজাদা, গুলিখোরদের আড্ডায় যাচ্ছিস নাকি আজকাল?’
—‘আজ্ঞে না কর্তা। তবে কিনা কাল পষ্টাপষ্টি দেখলুম যেন, নিশুতরাতে খুড়ো কদমতলার পেছনের বাঁশঝাড় দিয়ে যাচ্ছেন, অন্ধকারে মাথাটা সবুজ বলে মনে হল।’
—‘কি দেখতে কি দেখেছিস!’
বিশু মাথা চুলকে বলল, ‘তা হয়তো হবে কর্তা, তবে সুরকিকলের অতবড় সাঁকোটা যে পেরিয়ে গেলেন লাফ দিয়ে, সেটাও কী দিনের আলোয় ভুল দেখলাম।’
‘হুঃ’, কবিরাজমশাই তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন, সকালে পিত্তনাশ, বায়ুনাশ, কোষ্ট পরিস্কার না হলে লোকে অমন খোয়াবই দেখে। আচ্ছা তুই এখন আয়। আমার রুগী দেখার সময় হল।
বিশু প্রনাম করে বিদায় নিল। কবিরাজমশাই চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। সন্ধ্যেবেলা হরিশরাজার জঙ্গলে ঢোকা মোটেও কাজের কথা নয়। সাপ, বিছে, বুনো কুকুর, শেয়াল, বন্যজন্তু ছাড়া আর যেসব আছে তা মোটেও ইহলৌকিক জগতের মধ্যে পড়ে না। পাগল ছাড়া ঐ জঙ্গলে রাতের বেলা কেউ ঢোকে নাকি। রাতের বেলা শেষ ঐ জঙ্গলে বাজী রেখে ঢুকেছিল দাশুবাবুর নাতি। পরদিন তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া যায়নি। তাও প্রায় এককুড়ি বছর হতে চলল। তারও আগে ব্রিটিশ আমলের কোনো এক সাহেব মাপজোক করতে এসেছিল। সেও তার চাকর সমেত উধাও হয়। খালি খাঁটি ব্রিটিশ ফেল্ট হ্যাটটুকু শুধু পাওয়া গেছিল। অবিশ্যি এসব বহুবছর আগেকার কথা।
চন্ডীমন্ডপ রোদে ঝলমল করছে। একে একে রোগী আসা আরম্ভ হল। বেলা বাড়তে হেলতে দুলতে এলেন দারোগা দুগ্ধবরন বাপুলি। পেছনে দুখানা হাফপ্যান্ট পরা লাঠি হাতে কনস্টেবল। তারা চন্ডীমন্ডপে ঢুকে উপস্থিত লোকজনকে প্রথমে এদিক সেদিক লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে, গুলঞ্চ গাছের টবটাতে পানের পিক ফেলে, দরজার পেছনে উঁকি ঝুঁকি মেরে, আড়চোখে কবিরাজমশাইকে দেখতে লাগল।
—‘কি ব্যাপার দুগ্ধবরন।’
দারোগাবাবু পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে হাঁপাচ্ছিলেন। নিতান্ত দরকার না থাকলে তিনি থানা ছেড়ে অসময়ে খুব একটা বেরোন না। প্রশ্ন শুনে একটু উদাস হয়ে বললেন, ‘শরীরে চোখটাই তো সবচেয়ে কাজের, তাই তো কবরেজমশাই।’
—‘কেন কেন। কি হল?’
—‘চোখে মনে হয় কম দেখছি জানেন। নইলে গিন্নী কি আর দশটা লুচি কম দিয়ে পার পেয়ে যান, নাকি আমার গোনাগুনতি রোজ চারটে সন্দেশ ভুল করে দুটো হয়ে যায়। চোখেই যদি কম দেখলাম তবে সাপ খাচ্ছি না ব্যাঙ খাচ্ছি, কি করে বুঝব বলুন। আর খেলামই যদি কম তাহলে এই কাজের ধকল সামলাব কি করে বলুন। কাজই যদি করতে না পারি তাহলে এই যে সরকার বাহাদুর আমাদের মাইনে দিয়ে পুষছেন আপনাদের সেবায় তারই বা কি হবে বলুন, আর আপনাদের সেবাই যদি—’
কবিরাজমশাই থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তবে আমি যে লোকেমুখে শুনলাম তুমি লুচি সন্দেশ কম খাচ্ছ ঠিকই তবে ক্ষীরপুলি আর পাটিসাপ্টার পরিমান নাকি বেড়েছে। হরকিষেন গোয়ালা সকাল বিকেল তোমাদের বাড়ি যাচ্ছে। ব্যাপার-স্যাপার দেখে তোমার শ্বশুর নাকি কাল কালীগঞ্জের হাটে গোরুর দরদাম করেছে।’
দুগ্ধবরন একটু বিরক্ত হয়ে রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললেন, ‘আজ্ঞে ছোটমুখের ওসব কথা শোনেন কেন। আমি একটু না হয় বেশী খাইদাই তাতে তোদের নজর করা কেন বাপু। দেখুন হরকিষেনের গোরুটাকে আমি একটু বেশীই নাহয় ভালবাসি, আর ক্ষীরপুলি আর পাটিসাপ্টা — ও তো দুধে একটু পিটুলি গোলার মতন। এই চেহারায় ওরা কোথায় হারিয়ে যায়। সেই কে যেন বলেছিলেন না ‘বন্যেরা বনে সুন্দর’ আর গোরুটা মশাই শ্বশুরের এমনিই দেবার কথা। ছাদনাতলায় কানে কথাটা তুলতে বলেছিলেন আপাতত একটিই সামলাও। দেখুন, এসব ইর্ষাকাতরদের কথা, দেখুন—’
—‘আহা বুঝেছি, বুঝেছি, তা কবে থেকে মনে হল চোখে কম দেখছ?’
—‘ইয়ে গতকাল সন্ধ্যে থেকে। তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বেলে, একটু জলবাতাসা খেয়ে সবে একটু চেয়ারে দেহ রেখেছি, এমন সময় গোবিন্দবাবু, মানে আপনাদের গোবিন্দ নারায়ন চক্রবর্তী থানায় এসে হাজির। ওনার কি সব ভালো লোকের খোঁজ চাই। তা আমি বল্লুম আমাকেই নিন না, যেমন চাচ্ছেন তেমনটিই পাবেন।’
—‘তাই বললে?’
—‘আজ্ঞে হ্যাঁ। তারপর শুনুন। তা বুড়ো বলে আমাকে দিয়ে হবে না, ওনার নাকি কিসব ভালো লোকেদের লিস্টি চাই। তা আমি বললাম এখানে তো মশাই উল্টোটাই পাবেন। বলতে অকর্মার ঢেঁকি, কুপমন্ডুক, আরো কি কি সব খারাপ খারাপ কথা বলতে লাগলেন।’
পেছন থেকে একটা পুলিশ বলল, ‘হাঁ হাঁ গায় ভ্যাঁস ভি বলিয়েছেন।’
দুগ্ধবরন চোখমুখ লাল করে বললেন, ‘এইও চোপ, মাইনে দিই না তোদের! লজ্জা করে না, এই যে সব ফি দিন গরমেন্টের পয়সা নিয়ে গামছা পরে থানায় বসে তাস খেলিস, সে সব কথা বড়সাহেবের কানে তুললে কী হবে জানিস?’
পুলিশ দুটো জিভ কেটে একটু তফাত গিয়ে লাঠি ঠুকতে লাগল।
দুগ্ধবরন পকেট থেকে ফের রুমাল বার করে মুখ মুছে বলতে লাগলেন, ‘যাক গে, তারপর শুনুন। বুড়োকে শেষমেশ তল্লাটে যত লোক আছে তাদের লিস্টি ধরালাম। আর ঠিক সেই সময় ঝপ করে লোডশেডিং।’
—‘তো, তাতে কি হল?’
—‘আরে ঐখানেই তো যত গন্ডগোল কবিরাজমশাই। নিকষ অন্ধকারে পষ্ট দেখলুম গোবিন্দবাবু লিষ্টি পড়ে যাচ্ছেন। এদিকে আমি তো আমার ভুঁড়িটাকে অবধি দেখতে পাচ্ছিলাম না। তাই ভাবলুম চোখটাই বুঝি গেল।’
কবিরাজমশাই একটু চুপ করে রইলেন। ব্যাপার স্যাপার মোটেই সুবিধার নয়। প্রথমে বিশু তারপর দুগ্ধবরন দুজনেই অশৈলী কান্ডের কথা বলছে। কিছু একটা ঘটছে তো বটে।
দুগ্ধবরন আরো কিছু মামুলি কথাবার্তার পর বিদায় নিল। উপস্থিত বেশ কিছু রোগীকে ওবেলা আসতে বলে কবিরাজমশাই বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে উঠে পড়লেন। ব্যাপারস্যাপার নিয়ে গুপী মাস্টারের সাথে একবার বসতে হচ্ছে।
No comments:
Post a Comment