Saturday, 17 December 2011

বব উইলিস ও একটি কালো কোটের গল্প- শেষ পর্ব

     শীতের রাতের জর্জটাউনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানকার লোকজন সব ঘরের ভেতর ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে পুরনো দিনের স্মৃতিচারণা করে। দূরে, গীর্জা থেকে ভেসে আসা ঘন্টাধ্বনি এবং কয়্যারের শব্দে তাদের সাধারণত মনে পড়ে নিজেদের সুখী দিনগুলোর কথা। এসব ভেবে তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবং শপথ নেয় আসন্ন বসন্তে অবশ্যই কোথাও তারা দলবেঁধে পিকনিকে যাবে।
    এই কথাগুলো বলার কারণ আমাদের গল্পের নায়ক বব উইলিস এই সমস্ত স্বাভাবিক সুখী ভাবনা ছেড়ে একটি অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল। কাজটি যে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কঠিন ও পরিশ্রমসাধ্য তাতে তার কোনো সন্দেহ ছিল না। তাই নিগ্রো বুড়োর মৃতদেহটা বস্তাবন্দী করে টেনে হিঁচড়ে রাস্তার শেষে বড় জঞ্জালের স্তূপের সামনে এনে ফেলে সে পরিতৃপ্তির হাসি হাসল।
     এই অবস্থায় তাকে কেউ দেখেনি। দেখা সম্ভবও ছিল না, কারণ জর্জটাউনের লোকেরা এত বোকাও নয় যে ঘরের ভেতর নিশ্চিন্ত আগুনের উত্তাপ ছেড়ে বরফঠান্ডা সিটিহল অ্যালির এককোণে কি হচ্ছে তার খোঁজ নেবে। হাঁফাতে হাঁফাতে বব নিজের অদৃষ্টকে গালমন্দ করছিল।
কত রাত হবে এখন? রাস্তায় জনপ্রাণী নেই। নিঝুম জর্জটাউনের অলিতে গলিতে শুধু হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ। রাত্রের নিজস্ব আলোয় দেখা যাচ্ছে বাড়ীঘরের জানালা দরজা বরফে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। হয়তো কাল সকালে রেডিওতে ওরা ঘোষণা করবে মরসুমের সবচেয়ে বেশী তুষারপাত গতকালই হয়েছে। বব লক্ষ্য করল, বরফের উপর বস্তাটাকে টেনে হিঁচড়ে আনার দাগ তৈরী হয়েছে। এতে অবশ্য সে ঘাবড়াল না কারণ সে জানে এই দাগ মুছে যেতে বেশী সময় লাগবে না।
     বস্তার মুখ খুলে সে একবার দেখল বুড়োর মুখটা। মাংসের টিনের কৌটোয় যেরকম হাস্যকর গবাদি পশুর ছবি দেওয়া থাকে ঠিক সেরকম। চোখ দু’টো এখনো খোলা। ববের মনে একটু করুণার উদ্রেক হওয়াতে সে হাত দিয়ে বুড়োটার চোখ দু’টো বুজিয়ে দিল।
—‘ঈশ্বর করুণাময়, ও আজ রাতেই মারা যেত। আমি শপথ করে বলতে পারি আমার কোনো ভূমিকা ছিল না এতে।’
স্বগতোক্তি করল বব। হঠাৎ মনে এলো বেনসনের কথা। সে নিশ্চয়ই আজ চেস্টারের পাবে ববের অপেক্ষায় ছিল। বিস্তর বোতল ওড়ানোর পর সে নির্ঘাত ববকে শাপমন্যি করে বিদায় নিয়েছে।
হাতের দস্তানাটা সামান্য টেনে নিয়ে বেশ একটু কসরত করেই বুড়োটার মৃতদেহ বস্তাটার ভেতর থেকে বের করে আনল বব। নিগ্রোটার ওভারকোটের ভেতরটা এখনো গরম। কোটখানা বেশ উঁচু মানেরই বলতে হয়। অন্তত সাধারণ গরীব নিগ্রোরা এগুলো পড়ে না। বব একটু পরখ করে দেখল।
     সময় নষ্ট করলে চলবে না, বলা যায় না টহলদার পুলিশ চলে আসতে পারে। সে যখন ঠিকই করে ফেলেছে জর্জটাউন থেকে পাকাপাকি বিদায় নেবে তখন ঝুটঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কি? তাছাড়া বেশীক্ষণ এই ঠান্ডায় থাকলে সে নিজেও কাবু হতে পারে।
বব লাশটাকে টেনে হিঁচড়ে দাঁড় করাল। তারপর কোনোরকমে পিঠে চাপিয়ে এক পা দুপা করে জঞ্জাল ফেলার বিরাট চৌকো ক্রেটটার দিকে এগোতে লাগল।
—‘এই তাহলে ব্যাপার, বব উইলিস, হলফ করে বলাই যায় তুমি আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মোটেই এই পরিস্থিতির কথা ভাবোনি।’
নিজের মনেই হেসে উঠল বব। গোটা ব্যাপারটার এরকম পরিণতি হওয়াতে সে নিজে যারপরনাই অবাক। সে ভেবেছিল নিগ্রোটার সাথে রাত্রে জমিয়ে খানাপিনা করবে।
     দেহটা ভীষণ ভারী, এবং ক্রেটটা বেশ উঁচু। সাধারণত সাফাইওয়ালারা বড়বড় ভারী যন্ত্রপাতিবোঝাই গাড়ি নিয়ে এসে ক্রেট সমেত তুলে নিয়ে যায়। ছোট ছেলেমেয়েরা যাতে ভুল করে ওর মধ্যে না গিয়ে পড়ে সেজন্য অমন উঁচু করা হয়েছে। সুতরাং, লাশটা ক্রেটটার ভেতর ছুঁড়ে ফেলতে হলে ববকে রীতিমতো কসরত করতে হবে। এবং যেহেতু সে জর্জটাউনের একজন সভ্য নাগরিক তাই সে যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলতে পারে না। বার দুই চেষ্টা করার পর বব হাঁপিয়ে পড়ল।
­—‘যীশুর দিব্যি! লোকটা এত ভারী কেন?’
কালো ওভারকোটটা এখনও বুড়োর গায়ে। বরফ কুচি পড়ে দিব্যি একটা নকশা তৈরী হয়েছে। দামী কোট। যেসব বড়লোকেরা জর্জটাউনের উত্তরে বাস করে তারা সাধারণতঃ এই জাতীয় কোট পছন্দ করে। হয়তো ওদেরই কারোর থেকে চুরি করেছে এই হতভাগা।
—‘আহা, আমি কি ভুল করছি, আমি তো এই কোটটা স্বচ্ছন্দে খুলে নিতে পারি।’
বব ঝুঁকে পড়ে ওভারকোটটা নিরীক্ষণ করতে লাগল।
—‘যদি বেঁচে থাকতে তাহলে তুমি অবশ্যই বলতে এটা তুমি কোথা থেকে পেয়েছ? হয়তো এটা আমি তোমার কাছ থেকে কিনেই নিতাম। তবে দু’ডলারের বেশি তুমি দাম পেতে না।’
বব বসে পড়ে ওভারকোটের বোতামগুলো খুলতে লাগল।
—‘এখন যেহেতু তুমি মারা গেছ, তাই তোমাকে টাকাপয়সার কথা বলে বিব্রত করতে চাইছি না। আর তাছাড়া স্বর্গ বা নরকে যেরকম ব্যবস্থা শুনেছি তাতে টাকাপয়সা নিয়ে গিয়ে বিশেষ লাভ কিছু হত না।’
ঠান্ডায় ববের আঙুলগুলো জমে আসছে। দ্রুত বোতামগুলো খোলার পর সে কোনোরকমে ওভারকোটটা উদ্ধার করল।
‘এইবার, মনে হচ্ছে আমি তোমাকে ঠিক জায়গায় নিয়ে যেতে পারব। কাল সকালে সাফাইওয়ালারা বাকিটা বুঝে নেবে’, নিগ্রোটার দিকে চেয়ে বিড়বিড় করল বব। ঠান্ডা তার শীতের পোষাক ভেদ করে হাড় অবধি পৌঁছে যাচ্ছে। নিজের প্যান্টের পকেট থেকে সে একটা ছোট্ট বোতল বার করল। এটা মিসেস হিগিন্‌সের অবদান। প্রবল শৈত্যে বব বিপদে পড়তে পারে ভেবে তিনি সরাইখানার গুদামঘর থেকে এটি সরিয়েছেন। বব একঢোঁক গলায় ঢেলে মিসেস হিগিন্‌সের উদ্দেশ্যে ধন্যবাদ জানাল।
—‘তুমি যদি আরো একটা রাত কাটাতে পারতে, তাহলে তোমাকে আমি চিংড়ীমাছের ব্যবসার অংশীদার করতে পারতুম। তবে তোমার কপাল মন্দ এটা বলতেই হয়।’
বব আর এক ঢোঁক খেল। লাশটা বরফের উপর শোয়ানো। ধীরে ধীরে বরফকুচিতে শরীরটা ঢেকে যাচ্ছে। ওভারকোটটা একপাশে রাখা।
—‘আমি চেয়েছিলাম তোমার উপকার করতে, তবে তোমার তো ব্যাপারটা মনপসন্দ হল না। তবে কি জান এই মুহূর্তে তোমার কবরের জায়গা হিসেবে এইখানটাই আমার পছন্দ। আর তোমার ওভারকোটটা আমি অবশ্যই নিয়ে নেব, কারণ তোমার খাওয়ার খরচা বাবদ মিসেস হিগিন্‌সের কাছে আমার কিছু ধার হয়েছে।’
তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে হবে। গলায় আর এক ঢোঁক ঢেলে বব বোতলটাকে পকেটে পুরলো। তারপর বুড়োর মৃতদেহটা কোনোরকমে তুলে ধরে সর্বশক্তি নিয়ে সে ছুঁড়ে দিল ক্রেটটার ভিতরে। এই বার তার প্রচেষ্টা সার্থক করে লাশটা ক্রেটটার ভিতরে গিয়ে পড়ল। হাল্কা নরম একটা আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে শিস্‌ দিয়ে উঠল বব। আপদ গেছে। চারিদিক একবার দেখে নিল সে। নাহ্‌, সিটিহল অ্যালির ভিতর জঞ্জালের স্তূপের কাছে এই ঘটনা লক্ষ্য করার মতো কেউ নেই।
     এবার যত দ্রুত সম্ভব ঘরে ফিরতে হবে। মুখ ফিরিয়ে হাঁটা শুরু করতেই ববের মনে একটু খটকা লাগল। কাজটা কি ঠিক হল? ওভারকোটটা খুলে নেওয়াটা বড় নিষ্ঠুর হল বোধহয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে একটা নিগ্রো বুড়োটার মৃতদেহ ঠিক কতখানি সম্মানের যোগ্য। যদিও একজন প্রকৃত ক্যাথলিক হিসেবে তার উচিত ছিল ওর সৎকার করা কিন্তু পাদ্রী সাহেব যে বলেন ওদের মধ্যে শয়তান বাস করে, নরকের আগুনে ক্রমাগত পোড়ে বলেই ওদের গায়ের চামড়ার রঙ কালো। সেক্ষেত্রে...
—‘হা ঈশ্বর!’
মুহূর্তের দ্বন্দ্ব কাটিয়ে বব শপথ নিল তার এই কৃতকর্মের কথা সে কাউকে জানাবে না। কেউ জানবে না বব উইলিস, জর্জটাউন কোলিয়ারীর শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা, একটা মৃত নিগ্রো বুড়োর দেহ থেকে ওভারকোট খুলে নিয়েছিল।
‘কি অদ্ভুত রাত্রি’, স্বগতোক্তি করল বব, তারপর রাস্তা থেকে ওভারকোটটা তুলে নিয়ে গায়ে চড়িয়ে সে হাঁটা দিল সরাইখানার উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে তার মনে হল জর্জটাউন আর তাকে কোনো বিস্ময় উপহার দিতে পারবে না, এ শহর এখন তার কাছে বাতিল আবর্জনার মতোই ফেলনা। শূন্য থেকে নেমে আসা রাশি রাশি তুলোর মত পেঁজা বরফের দিকে তাকিয়ে সে মনস্থির করে ফেলল হ্যামন্ডের সামুদ্রিক উষ্ণতা তাকে পেতেই হবে। মাথা নিচু করে সে সিটিহল অ্যালির নোংরা বাঁচিয়ে দ্রুতপায়ে হাঁটতে লাগল, তারপর একসময় মিলিয়ে গেল গ্যাসবাতির আধো আলোয় ঢেকে রাখা ক্রাম্যার্স স্ট্রীটের ধোঁয়াশার ভিতর।
     আমাদের গল্প এইখানে, সিটি হল অ্যালিতে বব উইলিসের অপসৃয়মান চেহারার প্রেক্ষাপটেই সমাপ্ত হচ্ছে তবে শেষকথা হিসেবে একটা তুচ্ছ ব্যাপার বলা যেতেই পারে যেটা আমাদের গল্পের নায়ক এখনো জানেনা। সেটা হল, যে ওভারকোট সে এইমাত্র গায়ে চড়িয়েছে তার ডানপকেটে একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো ও পেন্সিল রয়েছে। যাতে লেখা আছে, ‘আমার মৃত্যুর পর ওভারকোটখানি যেন মিঃ বব উইলিসকে দিয়ে দেওয়া হয়, মাংস ও মদের দাম বাবদ, ধন্যবাদ।’

বব উইলিস ও একটি কালো কোটের গল্প- পর্ব ৫

সিঁড়ি দিয়ে প্রায় নিঃশব্দে উঠে যাচ্ছিল বব। একতলায় টি টেবিলের সামনে মিসেস হিগিন্‌স এখনো বসে আছেন। টেবিলের উপর চা ও রুটির টুকরো রাখা। ওঁর প্রিয় বেড়ালটি ওঁর কোলের উপর শুয়ে ঝিমোচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে উনি নির্লিপ্তভাবে সোয়েটারের ঘরের মাপ পরখ করছিলেন তবুও কাঠের সিঁড়ির হতাশ ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তাঁর কান এড়াল না। এর মানে হচ্ছে বব উইলিস বিমর্ষ।
—‘সব কিছু ঠিক আছে তো বব? আমি কিছু সাহায্য করতে পারি?’
—‘ধন্যবাদ, মিসেস হিগিন্‌স, আশা করব কাল সকালের আগে আপনার দরকার পড়বে না।’
‘দেখো বব’, মিসেস হিগিন্‌স হাতের কাজ থামালেন, ‘আমি চাই না তুমি কোনো ঝামেলায় জড়াও। আমার মনে হয় বুড়োটাকে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় বিদায় করাই ভালো।’
বব মাথা নীচু করে বলল, ‘আমি অবশ্যই চেষ্টা করব। আশা করছি কাল সকালে—’
—‘দেখ আমাকে পাদ্রীসাহেব বলেছেন, এরা ভীষণ অকৃতজ্ঞ হয়। তাছাড়া কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে যে নিগাররা নাকি বলশেভিকদের দেখাদেখি গোলমাল করার চেষ্টা করছে। শুনছি সরকার থেকে প্রচুর ধরপাকড় আরম্ভ হয়েছে। কাগজে কি লিখেছে শোনো, ‘আমেরিকা আমেরিকানদের জন্য’।’
—‘আমি বিস্মিত হলাম মিসেস হিগিন্‌স, তবে এ লোকটা নেহাতই গোবেচারা।’
‘তাই যেন হয় বব, তবে আমার কথাটা মনে রেখো’, মিসেস হিগিন্‌স উঠে দাঁড়ালেন, ‘শুভরাত্রি বব।’
—‘শুভরাত্রি মিসেস হিগিন্‌স।’
বব বিষন্ন মনে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে নিজের ঘরের দরজার হাতল ঘোরালো। নিগ্রোটার হুঁশ ফিরেছে কি? মাংসের টুকরোটা কি খেয়েছে ও?
     দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই একরাশ চমক ববের জন্য অপেক্ষা করছিল। এ চমক ক্রিসমাসের উপহার পাওয়ার আনন্দের মতো নয়, বা কয়লাখনির ভিতর পাথর খুঁড়ে হঠাৎ একটুকরো হীরে পাওয়ার উত্তেজনার মতোও নয়, এ অন্যরকম অনুভুতি। শীতের রাতে প্রথম তুষারপাতের পর সকালে ঘুম থেকে উঠেই কোন ঘুঘু পাখিকে জানালার পাশে মরে পড়ে থাকতে দেখার মতো। বব প্রথমে ব্যাপারটা ঠিক অনুধাবন করতে পারেনি। কিন্তু মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা নিস্পন্দিত দেহ, নিস্পলক চোখ, মুখের কষ বেয়ে নামা ফেনা, হাত থেকে ছিটকে পড়া মাংসের টুকরো ববকে প্রায় ঘাড় ধরে বুঝিয়ে দিল যে সে এই মুহূর্তে একটি নিগ্রো মানুষের মৃতদেহের দিকে চেয়ে আছে।
হা ঈশ্বর! বব মৃদু স্বরে ডুকরে উঠল। ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে নিগ্রো বুড়োটার গায়ে পা দিয়ে একটু খোঁচা মারল সে। দেহটা নড়ল না, কোনো সন্দেহ নেই এতক্ষণে বুড়ো স্বর্গে পৌঁছেছে। অবশ্য ওর গায়ের রঙ তো কালো, ওরও কি স্বর্গে যাওয়ার কথা?
     ও হয়তো উঠে এসে মাংসটা খাওয়ার চেষ্টা করেছিল, সিদ্ধান্ত করল বব। বহুদিনের অভুক্ত শরীর আর সইতে পারে নি। হয়তো শেষ মুহূর্তে ঐ মাংসের টুকরোর দিকে চেয়েই ও মারা গেছে। এমনও হতে পারে যে ও ববকে ডাকার চেষ্টা করেছিলো। হয়তো নিচের তলায় মিসেস হিগিন্‌স ওর আর্তনাদ শুনতে পাননি। তাছাড়া শুনতে পেলেও কোনোও লাভ হত কি?
     কিন্তু এবার কি হবে? বব শিউরে উঠল। এই নিগ্রোটার মৃতদেহ নিয়ে কি করবে সে এখন? ভয়ভাবনায় তার কান্ডজ্ঞান লোপ পাচ্ছে। তড়িঘড়ি সে সিঁড়ির উপর থেকে চিৎকার করে মিসেস হিগিন্‌সকে ডাকল। অবশ্য খুব জোরে চেঁচাতে সে সাহস পেল না কারণ সে চাইছিল না অন্য বোর্ডাররা ব্যাপারটা জানুক।
মিসেস হিগিন্‌স রাতপোশাকের উপর একটা ওভারকোট মতন চড়িয়ে হলঘরে বেরিয়ে এলেন।
—‘কি ব্যাপার বব?’
—‘নিগ্রোটা,…মারা গেছে!’
—‘হায় ভগবান! কি ভাবে?’
বব মাথা নাড়ল। মিসেস হিগিন্‌স দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে ববের ঘরে উঁকি দিলেন।
‘ওহ্‌ বব, বব, আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম, আমি তোমাকে সাবধান করেছিলাম’, মিসেস হিগিন্‌স প্রায় কাঁদো কাঁদো। বব কোনো কথা না বলে পকেট থেকে রুমাল বার করল।
‘ধন্যবাদ বব’, রুমালে চোখ মুছে মিসেস হিগিন্‌স ভালো করে নিগ্রো বুড়োটাকে দেখতে লাগলেন। তারপ সন্তপর্ণে কাছে গিয়ে মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে হাত রাখলেন। মারা গেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
—‘কি সর্বনাশ বব। এখন কি হবে?’
কিছুই মাথায় আসছিল না ববের। কি জন্য মারা গেল বুড়োটা? বহুদিন না খাওয়ার জন্য! না কি বেজায় ঠান্ডা ওর বুড়ো হাড় নিতে পারে নি। ধীর পায়ে ক্লান্ত ভাবে বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিল সে। শেরিফকে বা টহলদার পুলিশের অফিসে খবর পাঠানো যেতে পারে। ওরা হয়তো এসে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারে।
—‘আমার তা মনে হয় না বব, লোকজানাজানি হলে সরাইখানার সুনামের কি হবে ভেবে দেখেছ একবারও? যীশুর দিব্যি বব, দোহাই ও কাজ কোরো না।’
হতাশ হয়ে বিছানায় বসে রইল বব। ফায়ারপ্লেসের আগুন এখনো জ্বলছে। ঘর এখন বেশ গরম। যদিও বব সেই উত্তাপ উপভোগ করার মতো অবস্থায় নেই। সে ভাবতে লাগল, এসব কিছুই ঘটেনি, নিছকই একটা স্বপ্ন, হয়তো এখুনি সে জেগে উঠে শুনবে সকালের প্রতরাশের জন্য মিসেস হিগিন্‌স তাকে ডাকাডাকি করছেন।
‘একে তুমি কোথায় পেলে বব?’ মিসেস হিগিন্‌স একটু সামলেছেন নিজেকে। হলুদ আলোয় তাঁর মুখ বিবর্ণ দেখাচ্ছে।
বিমর্ষ কন্ঠে বব উত্তর দিল, ‘সিটিহল অ্যালির ভিতরে। রাস্তায় ধুঁকছিল। আচ্ছা ওর জামাকাপড় পকেট এসব খুঁজে দেখলে হয় না, যদি কিছু নাম ঠিকানা হাল হদিস পাওয়া যায়?’
‘ওহ্‌ বব, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, তুমি এখনো শিশুই রয়ে গেছো। আমি চাই না লোকে ব্যাপারটা জানুক। আজকাল ব্যবসাপাতির অবস্থা তো জানোই, এসব জানতে পারলে শহরে নানারকম গুজব রটবে, তখন…’, মিসেস হিগিন্‌স ফের ফোঁপাতে লাগলেন।
—‘আমার সহানুভূতি, মিসেস হিগিন্‌স।’
মিসেস হিগিন্‌স সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। সামান্য উত্তেজিত। বব লক্ষ্য করল তাঁর হাত কাঁপছে।
‘শোনো, চলো লাশটার কিছু একটা করি। জানাজানি হওয়ার আগেই।’
বব মিসেস হিগিন্‌সের দিকে চাইল। আপাতনিরীহ ভদ্রমহিলা। সাধারণ বেশবাস। সাতেপাঁচে থাকেন না। প্রত্যেক সন্ধ্যায় মিস্টার হিগিন্‌সের বিরক্তিকর পিয়ানোর একমাত্র শ্রোতা। বব কখনো তাঁকে জর্জটাউনের ভবিষ্যৎ নিয়ে মতামত দিতেও শোনেনি। সেই মহিলা তাকে সাংঘাতিক একটি কাজ করার পরামর্শ দিচ্ছেন দেখে বব অবাক না হয়ে পারল না।
—‘তুমি কি কাউকে বলেছ, এই নিগ্রোটার কথা?’
বব ইতস্তত করল।
—‘এক সার্জেন্ট, আর মুদীখানার রবিন্‌স।’
—‘তোমার কান্ডজ্ঞানের তারিফ করতে হয় বাছা। ঈশ্বর কি তোমাকে বুদ্ধি ছাড়া পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন? চারিদিকে কি হচ্ছে তা জানো না?’
বব জানে। গতকালই পোটোম্যাক নদীর ধারে একটা মাছের বোটের ভেতর তিনজন নিগ্রোকে খুন করেছে ওরা। বোটের মালিককেও একই সঙ্গে মেরে নোটিশও লটকেছে।
‘শোনো, আমার কাছে মাংসকাটার বড় ধারালো ছুরি আছে। আমরা ওকে কেটে ছোট ছোট টুকরো করে ফেলতে পারি। তারপর ব্যাগে ভরে কোথাও ফেলে দিতে পারি’, একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে মিসেস হিগিন্‌স ববের দিকে চোখ বড়বড় করে চেয়ে রইলেন। অনুমোদন পাওয়ার অপেক্ষায়।
—‘ওকে টুকরো করবেন?’
—‘ভেবে দেখ বব, কেউ জানতে পারবে না। পুলিশ জিজ্ঞাসা করলে বলবে, শেষবার ওকে তুমি ব্রডওয়ের দিকে যেতে দেখেছ।’
বব ব্যাপারটাতে রাজী হল না। তার ধারণা নিগ্রোটার পিঠের হাড় খুবই শক্ত, সুতরাং ছুরি দিয়ে কাটা যাবে না। চারিদিক রক্তারক্তি হবে।
—‘বব, আমি এসব বরদাস্ত করবো না, এই ঝামেলা তুমি নিয়ে এসেছো, তোমার কি মনে হয় না তোমাকেই ব্যাপারটা সাফ করতে হবে।’
—‘অবশ্যই মিসেস হিগিন্‌স, আমি মেনে নিচ্ছি এ আমার দোষ। নিজেকে নীচ লাগছে। কেন যে আমি আপনাদের বিব্রত করলাম। ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করবেন না। মনে হচ্ছে সমস্ত সৎ ও ভালো কাজ করার যোগ্যতা আমি হারিয়েছি। যেমন মেরীকে ঘোড়ায় চড়া শেখানো।’
মিসেস হিগিন্‌সের মুখ পলকে আরক্ত। বব বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। চুল্লীর আগুন আরো একটু উস্কে দিয়ে সে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। বাইরে অবিশ্রান্ত বরফ পড়ছে। তার বহুদিনের সঙ্গী জানালার পাশের ইউক্যালিপ্টাস গাছের পাতার সবুজ রঙ প্রায় অন্তর্হিত। এক বিরাট ক্রিসমাস ট্রী যেন।
—‘কোনো মতলব বব?’
মিসেস হিগিন্‌সের দিকে ঘুরে দাঁড়াল বব। মহিলা দরজার ধার ঘেঁষে রাগত মুখে তাকিয়ে আছেন। তাঁর সামনেই নিগ্রোটার মৃতদেহ। বব ভাবল, ইস্‌ ও যদি জানতে পারত ও হেভেনে কয়েক টুকরো অবস্থায় যাবে তাহলে এইভাবে মরার ঝুঁকি নিত না। নিগ্রোটার দিকে চেয়ে বব নিচু গলায় বলল,
—‘শুনুন, সার্জেন্ট র‌্যামোস আমাকে একটা পরামর্শ দিয়েছিল, বুড়োটাকে রাস্তার মোড়ের জঞ্জালের উপর ছুঁড়ে ফেলতে।’
‘তবে তাই কর না কেন?’, মিসেস হিগিন্‌স উৎসাহিত হলেন।
—‘দেখুন, আমার মনে হয় ওর পরিবার ইত্যাদির খোঁজ একবার করা উচিত। তাহলে বিবেকের কাছে —’
—‘তোমাকে পরিষ্কার বলছি বব। জর্জটাউনে যারা ছুটি কাটাতে আসে তারা আমার সরাইখানা ভীষণ পছন্দ করে কারণ এখানে গোলমাল হয় না, এখন যদি এসব…’
মিসেস হিগিন্‌সকে হাত তুলে থামিয়ে দিল বব। সে জানে ওঁর আপত্তি যুক্তিসঙ্গত। আশ্বস্ত করে সে মিসেস হিগিন্‌সকে চিন্তামুক্ত হওয়ার অনুরোধ জানাল, কেননা সকাল হওয়ার আগেই সে বুড়োকে জঞ্জালের স্তূপে ছুঁড়ে ফেলে আসবে।

Thursday, 15 December 2011

বব উইলিস ও একটি কালো কোটের গল্প- পর্ব ৪

     রাস্তার পেভমেন্ট ধরে চলতে বব ভীষণ ভালোবাসে, কারণ জর্জটাউনের কোথায় কী হচ্ছে সে সব জানার সেরা উপায় হল ঐটে। এতে কি হয়, হাঁটার একঘেয়েমিটা কিছুটা কাটে। যেমন গত বিষ্যুদবার সে জেনেছিল শহরের নতুন রেস্তোঁরার উদ্বোধনের কথা এবং মেয়েদের নেলপলিশের নতুন ফ্যাশন। শহরের সবচেয়ে ধনী বাউন্ডুলে কিংবা দাবার কোনো নতুন চাল। মধ্যবয়সীদের পেছু পেছু হাঁটলে তাদের বিরক্তিকর স্ত্রীদের বিচিত্র খেয়ালের কথাও জানা যায়। লাঠি হাতে বুড়োগুলো সেরকম আকর্ষণীয় নয় কিন্তু ছেলে ছোকরাগুলো বেশ মজাদার। ওদের আলোচনা থেকেই বব জেনেছে যে জর্জটাউন পাবলিক স্কুলে এখনও নিগ্রো ছেলেমেয়েদের জল খাবার জায়গা আলাদা।
     কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, শীতের রাতে যখন চতুর্দিকে বরফ পড়ছে, অল্প কুয়াশায় দূরের কিছু দেখা যায় না, তখন লোকজন সব নিজের সাথেই একমাত্র কথা বলে। শীতকালেই বোধহয় সবাই তাদের নিজেদের স্বাস্থ্য, বাড়ীর মর্টগেজ, ছেলেমেয়েদের স্কুলের অনুষ্ঠান এবং নিজেদের জীবনের কথা ভাবে। মাথা নিচু করে ঘাড় গুঁজে যতটা সম্ভব ঠান্ডার আঁচড়কামড় বাঁচিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মানুষ নিজের কাছেই অজান্তে ফিরে আসে বারংবার। সুতরাং বব এমন একজনকেও পেল না যে তার ক্ষণিক আগেকার মহৎ কীর্তির কথা জানতে উৎসুক।
     অবশেষে রবিন্‌সের মুদিখানার কাছাকাছি পৌঁছে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। দরজা বন্ধ যদিও ভিতরে আলো জ্বলছে। চেস্টারের পাবে না হয় পরে যাওয়া যাবে, আপাতত রবিন্‌সকে একটু বাজিয়ে দেখা যাক, যদি কিছু সাহায্য পাওয়া যায়। রবিন্‌স কি সওদায় ব্যস্ত এখন? কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে একটি অল্পবয়সী মুখ দরজার ঝাপসা কাচের ওধারে উঁকি মারল।
—‘খোলো হে, যীশুর দিব্যি।’
অল্পবয়সী মুখের ছোকরাটি রবিন্‌সের ছেলে। ক্ষণিক ইতস্তত করে সে দরজা খুলে দিল। ভেতরটা বেশ গরম।
—‘আমি ভেবেছিলাম রবিন্‌সের সাথে দেখা করবো।’
‘কি চাই তোমার, বব’, উত্তর এল ঘরের কোণ থেকে। বড়সড় পশুচামড়ার কম্বল জড়িয়ে বেঁটে খাটো রবিনস কৌচের উপর বসে আছে। গ্যাসবাতির আলোয় ওর মুখটা পাঁশুটে দেখাচ্ছে। তার হাতে সকালের খবরের কাগজ, মুখে পাইপ। ঘরের ভেতর নানারকম মালমশলার ক্রেট। একপাশে উঁচু টেবিলের উপর বিভিন্ন প্রাচ্যদেশীয় মশলার প্যাঁটরা।
একটু কেশে গলা সাফ করে বব বলল, ‘একটু উপকার যদি কর রবিন্‌স।’
—‘তোমার কি মনে হয় না, আবহাওয়াটা ঠিক উপকার করার উপযুক্ত নয়?’
—‘তা বটে, তবে আমার শুধু একটু রুটি দরকার ছিল।’
—‘বেশ তো, এ আর এমন কি কথা। পয়সা ফেল, সানন্দে রাজী থাকব।’
বব একথায় একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলল, যেটা রবিন্‌সের নজর এড়াল না।
‘দেখো বব, এমনিতে আমি খুব খারাপ লোক কিন্তু আমার ঠাকুর্দার একটি শিক্ষা আমি পেয়েছি, সেটা হল ঘরের বউ এবং দোকানের মাল কখনো ধারে বেচতে নেই’, রবিন্‌স বিশ্রী ভাবে হেসে উঠল। সারা শরীর জুড়ে হাসছে। বব লক্ষ্য করল হাসির দমকে ওর মুখ লাল হয়ে উঠেছে।
বব স্থির করল, এই জাতীয় মানুষেরা মানবতার শত্রু এবং এদের কাছে মানুষের মহৎ প্রচেষ্টার কোনো দাম নেই। নেহাত মাইনের টাকা পয়সা সে উড়িয়ে দিয়েছে, না হলে রবিন্‌সের সাথে ফালতু বাক্যালাপ করার লোকই সে নয়। কুড়ি ডলার মাত্র তার সম্বল, হ্যামন্ড যাওয়ার ট্রেনভাড়া, কিছুতেই সে সেটাকে খরচ করবে না। সে ভাবল বুড়ো নিগ্রোটার স্বার্থে আরেকবার অনুনয় করে দেখবে।
—‘আমি অবাক হচ্ছি বব। হিগিন্‌স কি তোমার খেয়াল রাখছে না। নাকি রোজকারপাতি ছেড়ে দিলে?’
বব বিরক্ত হল। কোটের কলার থেকে বরফকুচি পরিষ্কার করতে করতে সে বলেই ফেলল আসল কারণ। এটাও জানাতে ভুলল না যে ঈশ্বর কালো মানুষদেরও নিজের সন্তান ভাবেন এবং পরের মাসে মাইনে পেলে সে প্রথমে রবিন্‌সের ধারই শোধ করবে।
—‘শোনো, তুমি ভুল দিনে এসেছো। সাধারনত রবিবার যখন গীর্জায় যাই তখনই একমাত্র আমি ধর্মপ্রাণ খ্রীষ্টান, বাদবাকি সময় আমি শয়তানের পরামর্শ অনুযায়ী চলি। যেমন এখন সে আমায় বলছে যে, তোমার উচিত আমার কুকুরটার জন্য কিছু খাবার কিনে দেওয়া কারণ, ওর গায়ের রঙও কালো।’
দড়াম করে দরজাটা টেনে বেরিয়ে এলো বব। আসার সময় সে শুনতে পেল, রবিন্‌স তুমুল হাসতে হাসতে বলছে, ‘নিগ্রোটাকে ধোলাই দেওয়ার দরকার পড়লে আমাকে বলো, বব। একাই আনন্দটা উপভোগ কোরো না যেন।’
নিপাত যাও! তোমার জন্য নরকও যথেষ্ট নয়। বব ভীষণ রেগেমেগে হন্‌হন করে চলতে লাগল। বুড়ো বেনসন জর্জটাউনের দোকানীদের যে মানুষ বলে গন্য করে না তার যথেষ্ট কারণ আছে তাহলে।
ক্রামার্স স্ট্রীটের শেষে আরো দু’টো বেকারী আছে। ববের মনে হল সব দোকানীই রবিন্‌সের মতো হৃদয়হীন হবে না নিশ্চয়।
     কিন্তু ববের কপাল মন্দ। দু’জায়গাতেই তাকে গলাধাক্কা খেল সে, এমনকি কিছু লোক বিদ্রুপ করতেও ছাড়ল না। কেউ কেউ গীর্জার কাজকর্ম সম্পর্কে তো সন্দেহই প্রকাশ করে ফেলল। হতাশ হয় বব যখন ভাবছে এরপর কোথায় যাওয়া যায়, ঠিক তখনই তার মনে হল ঈশ্বর বোধহয় ওই জমানো ডলারগুলোর ওপর বিরক্ত। ঠিক আছে, উপরওয়ালার ইচ্ছানুযায়ীই সে কাজ করবে। দাঁতে দাঁত চিপে সে সংকল্প করলো নিগ্রো বুড়োটাকে সে সুস্থ করে তুলবে, দরকারে তার নিজের জমানো টাকা খরচ করেই।
     রাগের চোটে কিছুক্ষণ এলোমেলো রাস্তায় ঘোরার পর অবশেষে কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সে মাথা নীচু করে রওনা দিল বাড়ির দিকে।

বব উইলিস ও একটি কালো কোটের গল্প- পর্ব ৩

     বব উইলিসের দোতলার ঘরে যদি আপনি কোনকালে পা রাখেন তো প্রথমেই আপনার চোখে পড়বে একটা পুরু গদিওয়ালা বিছানা, সেই সঙ্গে টেবিলের উপর একটা কাঁচের জারের মধ্যে গোল্ডফিশ, দেওয়ালে ওয়ালরথ পাইপ রেঞ্চ কোম্পানির ক্যালেন্ডার। এছাড়া আশেপাশে চোখ বুলোলে দেখতে পাবেন একটা সস্তা কাঠের আলমারি এবং ববের সাধের ইজিচেয়ার যার উপর একটা ময়লা তোয়ালে রাখা। এই সব দেখে যখন আপনি ভাবছেন যে বব মানুষটি ভীষণ সাদাসিধে ঠিক তখনই আপনার চোখে পড়বে ঘরের এককোনায় রাখা বইয়ের র‌্যাক যেটি দর্শনের বইয়ে ঠাসা এবং তৎক্ষনাৎ আপনি বব সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত বদলাবেন। কিন্তু আসল ব্যাপার হল এসব বই সে কোনোকালেই পড়ে না, ওগুলো নিতান্তই তার পৈতৃক সম্পত্তি।
     বব শুধু বিছানায় শুয়ে কোলিয়ারীর ইউনিয়নের সাপ্তাহিক মুখপত্র পড়তে ভালবাসে কেননা সে এটা প্রায় ছোটোবেলা থেকেই পড়ে আসছে। চুপ করে বিছানায় শুয়ে সিলিং এর দিকে চেয়ে বহুদিন আগেকার ‘দি লেবার উইকলি’র পাতায় চুল রঙ্গীন করার বিজ্ঞাপন, কিংবা ব্যালেরিনাদের ছবির কথা ভাবা তার বহুদিনের অভ্যাস। তার মনে পড়ে গ্যারি শেফার্ডের জাঁকালো জোক্‌সগুলোর কথাও, কিন্তু শীতকালে সেসবে সে বিরক্ত বোধ করে। মাঝে মাঝে অলস ভাবে বিছানায় শুয়ে ববের নিজেকে মনে হয় কারাগারের বন্দী যেখানে তার সঙ্গী বলতে কেবল তার হাতঘড়ি এবং তার বিছানা। তার বহুদিনকার পুরনো বিছানা যেখানে এখন নিগ্রো বুড়োটা কোট জুতো সমেত শুয়ে আছে।
     ঘরের আলোয় বুড়োকে ভালো করে লক্ষ্য করল বব। কোলকুঁজো চেহারা। মুখখানা হাঁ করে হাপরের মতো শ্বাস নিচ্ছে। সাদা দাড়ির সাথে বরফকুচি মিশে আছে। ববের মনে হল থিয়েটারে ওকে বুড়ো চাকরের ভূমিকায় ভালো মানাবে।
‘এই তবে ব্যাপার, তা আমাকে খুলে বলতে পারো সব।’ বব ফায়ারপ্লেসের চুল্লীতে কাঠকয়লা গুঁজতে লাগল। ঘর আরো একটু গরম হলে যদি বুড়োর হুঁশ ফেরে।
বৃদ্ধ লোকটি অবশ্য একইরকম ভাবে শুয়ে রইল। পা দু’টো মুড়ে একটা হাত মাথার পেছনে দিয়ে একপাশে কাত হয়ে। চোখ দু’টো বোজা। ওর সারা শরীর এমনভাবে কোটে ঢাকা যে দেখে মনে হচ্ছে একতাল কালো কাপড় যেন কেউ দলা পাকিয়ে ফেলে রেখেছে। ববের একবার মনে হল কোনো ডাক্তারকে ডেকে আনার কথা। তার উপরতলাতেই তো একজন আছে, সবসময় সাদা পোশাক পরা ফিটফাট ছোকরা ডাক্তার। কিন্তু ফি দেওয়ার ক্ষমতা ববের নেই, তাছাড়া কালো মানুষ দেখে সে ছোকরা নাক সিঁটকে চলেও যেতে পারে।
—‘ওর দরকার পথ্য, আর সেটা আমিই জোগাড় করতে পারব। বলা যায় না কিছুটা খাবার খেলেই হয়তো ও সুস্থ বোধ করবে।’
জানালার সার্সিগুলো ভালো করে এঁটে দিল বব। নিজের কম্বলটা ওর কোটের ওপর চাপিয়ে দিল যাতে বুড়ো একটু আরাম পায়।
—‘ও নিশ্চয় আমাকে দেবদূত ভাবছে। ভাববে নাই বা কেন? এখনো অবধি যে ও বেঁচে আছে সে তো আমারই জন্য। কোনো সন্দেহ নেই, ঈশ্বর ব্যাপারটা লক্ষ্য করছেন।’
     চুল্লীতে আরও কিছু শুকনো কাঠ গুঁজে দিল বব। যতটুকু কাঠকয়লা সে সারা সপ্তাহের জন্য বাঁচাতে পেরেছিল তার প্রায় সবটুকুই। আরো উত্তাপ চাই। তাহলে বুড়োটা হয়তো গা হাত পায় জোর ফিরে পাবে। হয়তো উঠে বসে সে ববকে তার প্রাণ বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ জানাবে এবং বলবে আসলে সে জর্জটাউনে এসেছিল হার্লেম শহরের খবর নিয়ে। হয়তো এও বলবে যে তার মাছের স্যুপ ভালো লাগে না, সুতরাং বব যেন অন্য ব্যবস্থা করে। ফায়ার প্লেসের ধারে তার প্রিয় আরামকেদারাটা টেনে নিয়ে আগুনের উত্তাপে হাত পা সেঁকতে সেঁকতে বব কল্পনা করছিল, বুড়ো কৃতজ্ঞতা জড়ানো মুখে তার হাতে চুমু খাচ্ছে।
     এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ হল এবং বব এমনভাবে লাফিয়ে উঠল যেন সে এরই প্রত্যাশা করছিল।
—‘আসুন মিসেস হিগিন্‌স, আমি আপনার আসার অপেক্ষাতেই ছিলাম। মিঃ হিগিন্‌স রেওয়াজে ব্যস্ত বুঝি!’
—‘ওহ্‌, বব! সবই তো বোঝ। আচ্ছা, দেখো কিছুটা শুকনো মাংসই কেবল আমি তোমাকে দিতে পারি। আর এই কিছুটা মদ।’
—‘অশেষ ধন্যবাদ, আশা করব এতটাই আমাদের অতিথির জন্য যথেষ্ট।’
মিসেস হিগিন্‌স টেবিলের উপর কাঠের রেকাবিটা রেখে একটু ইতঃস্তত করে বললেন, ‘বড়দিনের ছুটিতে আশা করি তুমি মেরীকে ঘোড়ায় চড়া শেখাতে পারবে?’
—‘সানন্দে। একাজের জন্য মিঃ হিগিন্‌সের খামারবাড়িটাই আমি উপযুক্ত মনে করি।’
মিসেস হিগিন্‌সের মুখ একটু রক্তাভ হল। অস্বস্তির হাসি হেসে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
নিগ্রো বুড়োটা চোখ মেলে তাকিয়েছে। এখন আর ঘোলাটে দৃষ্টি নয়। কিছু যেন খুঁজছে। বব বিছানার পাশে গিয়ে বুড়োর মুখের উপর ঝুঁকে পড়ল।
—‘তুমি চাইলেই মাংসের টুকরোটা খেতে পার। কিছুটা মদও আছে।’
বুড়ো বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। ববকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে কি?
—‘দেখ নেহাত আমাকে চেস্টারের পাবে যেতেই হবে সে কারণে এক্ষুনি তোমার খিদমত করতে পারছি না। তুমি কিছু বলতে চাও কি? অন্তত নামটুকুও বলতে তো পার।’
বুড়ো চুপ করে রইল। ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁক করা।
—‘বেশ যেমন তোমার মর্জি। দেখ, আমি সাধারণত বেশী মদ খাই না, তবে আজকের কথা বলতে পারছি না। শোনো, নিচের একতলায় ওরা বসে আছে, কিছু প্রয়োজন পড়লে বেল বাজিয়ে বুড়ীটাকে ডেকো। ওর নাম মিসেস হিগিন্‌স তবে তুমি উইলেলা বলে স্বচ্ছন্দে ডাকতে পার।’
বাইরে এখনো বরফ পড়া থামেনি। সেদিকে চেয়ে হতাশ হয়ে বব তার হাতের দস্তানাটা আগুনের তাপে সেঁকতে লাগল। মন অন্যমনস্ক। শীতকালে এইরকম বরফ পড়া সন্ধ্যায় সে সাধারণত একতলায় বসে মিসেস হিগিন্‌সের সাথে নানান টুকিটাকি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। জর্জটাউনে সবজির আমদানী, পিয়ানোর কনসার্ট, ধর্মালোচনা বা ঈশ্বর কত করুণাময় ইত্যাদি। আজ সে বেশ প্রশান্তি অনুভব করছিল কেননা এরপর থেকে কেউ হয়তো রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় তাকে দেখিয়ে বলবে, ঐ যে বব উইলিস, একটা নিগ্রো বুড়োকে যে প্রাণে বাঁচিয়েছে। হয়তো শেরিফ তাকে একটা প্রশংসাপত্র লিখে দেবেন, ‘বব উইলিস…অমুক তারিখে অমুক ইত্যাদি’। নিজের মধ্যে মহতী গুণ আবিষ্কার করে বব একটু অবাক না হয়ে পারল না। সে তাহলে লোক খারাপ নয়।
     একটা শিস দিয়ে উঠল বব। নিজের প্রতি তার ভীষণ গর্ব হচ্ছে। দ্রুত গরম জামাকাপড় পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এল বব। তার দরকার একটু খোশগল্প এবং দুপাত্তর পান। একতলায় সোফায় বসে মিসেস হিগিন্‌স তাঁর বোনঝিকে সোয়েটার বোনা শেখাচ্ছিলেন। সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেয়ে দেখলেন, বব উইলিস নেমে আসছে। এক, দুই…এক, দুই, বেশ ছন্দ করে ক্যাঁচক্যাঁচিয়ে উঠছে কাঠের সিঁড়ি। মিসেস হিগিন্‌স ও আওয়াজ বিলক্ষণ চেনেন। ওর মানে বব উইলিস এখন ভরপুর আনন্দে মশগুল।

বব উইলিস ও একটি কালো কোটের গল্প- পর্ব ২

     ক্র্যামার্স স্ট্রীটের আশপাশ বেশ ঘিঞ্জি। কোলিয়ারীতে যারা কাজ করে তাদের অধিকাংশেরই এখানে বসবাস। বাড়িঘর সব গা ঘেঁষাঘেঁষি। যাদের একটু বেশি পয়সাকড়ি আছে, তাদের বাড়ির সামনে ছোট্ট বাগান। কারও বাড়ির দেওয়ালে ‘বেবিরুথ’ কোম্পানির চকোলেটের বিজ্ঞাপন সাঁটা। বেশ কিছু কালো চামড়ার লোকও এখানে থাকে, যাদের বাড়ির সামনে গেলে স্নোফ্লেক পুডিংএর গন্ধ পাওয়া যায়। এরা ভীষণ নোংরা এবং ঈশ্বরের অসীম দয়া যে এরা কখনো চেস্টারের পাবে ঢোকে না। যে কোনদিন সকাল আটটার সময় কারখানার ভোঁ বাজলে, সার সার জামা জুতো পরে কালো মানুষগুলো মাথা নিচু করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। বব তার দোতলার জানালা থেকে প্রায়শই দেখেছে ওরা পারতপক্ষে কখনো একা একা হাঁটে না। এদের বেশিরভাগই ভবঘুরের দল। কাজ পাওয়ার আশায় দলে দলে এসেছিল এককালে। পুরনো গীর্জার কাছাকাছি সরাই গুলোতে এখনও এরা গাদাগাদি করে থাকে।
     দরজা খুলে রাস্তায় বেরোতেই কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপ্টা লাগলো ববের চোখেমুখে। রাস্তায় প্রায় ছ’ইঞ্চি মোটা বরফের স্তর। সারাদেহ ঢাকা সত্ত্বেও বব কেঁপে কেঁপে উঠছিল।
—‘শুভসন্ধ্যা বব, ওঃ কি ঠান্ডাটাই না পড়েছে!’
বিলি জো, সবাই ডাকে লড়াকু জো বলে। দীর্ঘ চেহারা, মজবুত গড়ন, বাপের দর্জির দোকানে আগে কাজ করত। দু’বছর হল কোলিয়ারীতে ঢুকেছে। বব ওকে বিশেষ পছন্দ করে না কারণ বিলি জ্যাজ মিউজিক নিয়ে হুজুগেপনা ভালোবাসে এবং প্রতি রবিবার গীর্জায় গিয়ে সারাক্ষণ মেয়েদের সাথে ঠাট্টাতামাশা চালায়।
—‘শুভসন্ধ্যা জো! চললে কোথায়?’
—‘মিস আইভি রাইট আমাকে ওর বাসায় নেমন্তন্ন করেছে! হেঃ হেঃ।’
বব লক্ষ্য করল, জো এর বাঁহাতে একটা বড়সড় কাপড় ঢাকা বেতের ঝুড়ি। বোঝাই যাচ্ছে সন্ধ্যা উদ্‌যাপনের জন্য সে বেশ তৈরী হয়েই যাচ্ছে।
—‘আচ্ছা বব্‌, আমার তাড়া আছে, বুঝতেই তো পারছ। হেঃ হেঃ’
চুলোয় যাও। বব বিরক্ত হয়ে পা চালাল। এইসব লোকেদের থেকে সে সর্বদা দূরে থাকার চেষ্টা করে। পথচলতি উটকো লোকেদের এড়াবার জন্য সে গলিঘুঁজি দিয়ে চলতে লাগল।
     সিটিহল অ্যালির ভেতরে ঢুকে সে খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করল, কারণ রাস্তাটা অপেক্ষাকৃত নির্জন। সরু গলিটার দু’ধারে বেশ উঁচু বাড়ি থাকার জন্য বরফও একটু কম। একটু অন্ধকারও বটে। মাঝে মাঝে ফায়ার এস্কেপের সিঁড়ির তলার জানালার ফোকর থেকে বাড়ির ভেতরের আলো এসে পড়েছে। বেশ গা ছমচমে। চলতে চলতে বব জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে বাড়ির ভেতর উঁকি মারতে লাগল।
গলির শেষপ্রান্তে পৌঁছে বব দেখল, যেখানে পুরোনো বাতিল টায়ারগুলো একপাশে জড়ো করে রাখা, তার পাশে একটা অন্ধকার মতোন যেন দলা পাকিয়ে ঘুপচি হয়ে আছে। কৌতূহলী হয়ে কাছে যেতেই বব দেখল কেউ একজন হাত পা জড়োসড়ো করে হাঁটু মুড়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। আপাদমস্তক একখানা কালো কোটে ঢাকা। তার উপর বরফকুচি ছড়িয়ে রয়েছে। দূরের বড়রাস্তা থেকে যেটুকু আলো আসছে তাতে আর কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটা মৃতদেহ নয়, বব স্থির করল, কারণ মাঝে মাঝে গোঙানির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
একটা শিস দিল বব, ‘এইও, কে তুমি?’
কোনো উত্তর নেই।
বব এবার একটু ঠেলা দিল, ‘এইও, শুনতে পাচ্ছ?’
—‘দূর হ! শয়তান।’
বাব্বা, মেজাজ আছে বটে। বব একটু আমোদ পেয়ে ধীরে ধীরে ওর মুখের ওপর থেকে কাপড়টা সরাতেই দেখতে পেল, মাথায় সাদা চুল এক বুড়ো, মুখে অসংখ্য বলিরেখা, ঠিক যেমনটা তাদের শিফ্‌ট অপারেটরের মুখে রয়েছে, ঘোলাটে দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কালো মুখে চোখ দু’টো কোটরে ঢোকা, সাদাটে দাড়ি, হঠাৎ দেখলে মনে হয় কতদিন না খেতে পেয়ে রয়েছে। মুখের গড়নে অনেকটা ককেশীয় ছাপ স্পষ্ট।
—‘এমন শীতের সন্ধে কাটানোর উপযুক্ত স্থানই বটে, কি বল?’
বুড়ো কোনো জবাব দিল না, আপনমনে চোখ বুজে কি সব বিড়বিড় করছে।
একটু উসখুশ করল বব। লোকটা এমনভাবে এখানে বসে আছে কেন? এখানে শীতে জমে যেতে কতক্ষণ। অবশ্য ওর গায়ের কোটটা যদিও বেশ মোটা। পা দিয়ে কোটটা একটু উঁচু করে তুলে বুড়োর পায়ের কাছটা দেখল বব। যুদ্ধের পর সেনারা যেসব ছেঁড়া বুটজুতো বিক্রি করেছিল সেইরকমই একজোড়া বুটজুতো। বুড়ো ফের নড়ে উঠে একটু গোঙাল।
—‘এর থেকে নিজের ঘরে বসে আফিম খেলেই তো পারো। থাকো কোথায়?’
বুড়ো একথারও কোনো জবাব দিল না। শুধু তাই নয়, পরবর্তী পাঁচমিনিট ধরে ববের কোনো প্রশ্নেরই কোনো উত্তর দিল না। বাধ্য হয়ে বব স্থির করল বুড়ো হয়তো কানে খাটো অথবা উন্মাদ নয়তো সেইসব বেয়াক্কেলে লোকগুলোর একটা যাদের একমাত্র কাজ হল ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে পুরনো চিঠিপত্র পড়া।
বিরক্ত হয়ে বব স্থির করল এই ব্যাপারটা খোদ ঈশ্বরের উপরেই ছেড়ে দেওয়া যাক। পাদ্রী সাহেব যেমন বলেন, মুশকিলে পড়লে বাইবেলে বর্ণিত ওই ভদ্রলোকটিই তোমাকে পথ দেখাবেন।
এমন সময় গলিতে আরও একটি মানুষের আবির্ভাব ঘটলো। যার লাঠি এবং টুপি দেখে ববের চিনতে কোনো অসুবিধা হলো না। সার্জেন্ট র‌্যামোস। হাতে অর্দ্ধেক শেষ হওয়া বোতল। ববকে দেখে সে ধীর পায়ে এগিয়ে এল।
—‘আরে, আমাদের বব উইলিস যে। কী ব্যাপার বব, এই মারাত্মক শীতে সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়েছ নাকি?’
বব কোনো কথা না বলে ইশারায় বুড়োকে দেখাল।
সার্জেন্ট র‌্যামোস একটু ঝুঁকে পড়ে বুড়োটাকে দেখল। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘না হে, এ সেই লুটেরা বেঞ্জামিন রাইডার নয়। তুমি যদি ইনামের কথা ভেবে থাক, তাহলে বলতেই হচ্ছে তোমার কপাল মন্দ।’
—‘লোকটা কে?’
—‘কি করে বলব হে, আগে দেখিনি বলেই তো মনে হচ্ছে। হয়তো কাজের সন্ধানে এসেছিলো। ভবঘুরেও হতে পারে, তবে কোটটা খাসা বাগিয়েছে।’
—‘তোমার কি ওকে থানায় নিয়ে যাওয়া উচিত নয়? এখানে থাকলে তো শীতে মারা পড়বে।’
সার্জেন্ট র‌্যামোস বেশ বিরক্ত হল একথা শুনে। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘শোনো বব, তোমাকে আগে বলিনি, আমার এখন ডিউটি দেওয়ার কথাই নয়। নেহাত চেস্টারের পাবে গলা ভেজাতে এসেছিলাম বলেই না। আর তাছাড়া আমার বউ কত ভালো লেটুস পাতার স্যুপ বানায় তা জান। সেসব ছেড়ে এখন থানায়...তা, তোমার এত দরদ যখন নিজের সাথে নিয়ে গেলেই তো পারো। নতুবা শেরিফকে খবর দাও।’
বব কোনো কথা না বলে বুড়োটার দিকে চেয়ে রইল। রাস্তার ধারের গ্যাসবাতি গুলো জ্বলে উঠেছে। সেই আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে লোকটা ঠান্ডায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। ওর দিকে চেয়ে ববের করুণা হল। হয়তো ওর কেউ নেই, হয়তো ও আজ ডিনার টেবিলে বসে রুটিটা নোনতা বলেছিল, তাই হয়তো ওর বৌ ওকে বার করে দিয়েছে। হয়তো ও জর্জটাউনের রেলইয়ার্ডে কোনো কাজ চাইতে এসেছিলো, ওর বেঁটে বেঁটে হাত পা দেখে ওরা তাড়িয়ে দিয়েছে। ববের মনে হল এই সেই সময় যখন ঈশ্বর পরীক্ষা নেন মানুষের মানবিক বোধের। ঝট করে বব স্থির করল লোকটিকে সে বাড়ি নিয়ে যাবে।
পরিকল্পনাটা র‌্যামোসকে খুলে বলতেই সে একচোট হেসে বলল, ‘পাদ্রী সাহেব তোমার মাথা খেয়েছেন দেখছি। শোনো, লোকটা এমনিই মারা যাবে, রেডিওর খবর শুনেছ, টানা দু’দিন এরকম তুষারপাত চলবে। বুড়োর মরার ইচ্ছে হয়েছে, বুঝলে। এক কাজ কর, ওকে ওই যে বড় জঞ্জালের ঢিবিটা দেখছ, ওখানেই ছুঁড়ে ফেলে দাও না কেন। ব্যাপারটা কাল সকালের সাফাইওয়ালাদের ওপর দিয়েই যাবে।’
প্রস্তাবটা ববের মনঃপুত হল না। এমনও তো হতে পারে যে বুড়োটা হয়তো পথ হারিয়েছে, হয়তো ওর অন্য কোথাও যাওয়ার কথা। কোনো বাড়ি বা সরাইতে জায়গা না পেয়ে শেষে এখানে এসে বসে রয়েছে। ওর দরকার পর্যাপ্ত খাবার এবং ঘুম।
—‘বেশ নিয়ে যেতে পারো, তবে ফ্যাসাদে পড়তে পারো কিন্তু।’
সে যাই হোক, বব তবু একবার চেষ্টা করে দেখবে বৈকি। র‌্যামোসকে সে অনুরোধ করল তাকে একটু সাহায্য করার জন্য।
—‘মন্দ বলনি। মাঝে মাঝে আইনরক্ষক হিসেবে আমারও যে কিছু করনীয় আছে তা মনে করা ভাল। তাছাড়া একটু গা গরমও হবে।’
দু’জনে মিলে বুড়োর হাত পা ধরে তুলে নিয়ে চলতে লাগল। গলিটা একেই বেশ সরু, তাছাড়া যত্রতত্র টিন ক্যান আর জঞ্জাল আবর্জনায় ভর্তি, তাই ওদের চলতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল।
—‘তোমার কি মনে হয় বব? আমার কথাও ওপরওয়ালার ভাবা উচিত, নয় কি?’
—‘কেন বলতো?’
‘এই যে, তোমার মহৎ কাজে তোমাকে সাহায্য করছি, প্রতিদানে ঈশ্বরের আমাকেও কিছু দেওয়া উচিত। যেমন ধর ক্রিসমাস গিফ্‌ট হিসেবে একটা পুরোনো কনিয়াকের বোতল’, র‌্যামোস হাঁফাতে লাগল।
—‘তোমার রুচি আছে বটে, ওপরমহলে মেলামেশা কর নাকি?’
র‌্যামোস ঘাড় নাড়ল। সে বড়লোকদের দু’চক্ষে দেখতে পারে না, বিশেষ করে যারা র‌্যাকুন কোট পরে এবং দর্জির কাছে ট্রাউজারের নিচের মাপ চব্বিশ ইঞ্চি দেয়। তার দৃঢ় বিশ্বাস ভলস্টেড আইন চালু করার পিছনে এই লোকগুলোরই হাত রয়েছে। এদের জন্যই সিগারেটের প্যাকেট তাকে দশ সেন্ট দিয়ে কিনতে হয় এবং সুবিধা পেলে এই ধরনের বখাটেদের সে মজা দেখাবে।
     সরাইখানার সামনে পৌঁছে বব শুনতে পেল হিগিন্‌সের পিয়ানোর আওয়াজ। তার মানে মজলিশ এখনো শেষ হয়নি। সে র‌্যামোসকে ধন্যবাদ জানাল এবং এটাও জানাতে ভুলল না যে বব তার হয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবে। লোকজনের গলার আওয়াজ পেয়ে হিগিন্‌স কৌতূহলী হয়ে পিয়ানো ছেড়ে উঠে এলো।
—‘বাহ্‌, বেশ তো বব। শোনো, আমার সরাইখানা ট্রেভরের শুয়োর খোঁয়াড় পাওনি।’
—‘একটা রাতের ব্যাপার হিগিন্‌স, ও আমার ঘরেই না হয় থাকবে, শীতে কষ্ট পাচ্ছিল, তাই তোমার এখানে নিয়ে এলাম। কিছু খাবার পেতে পারি মিসেস হিগিন্‌স? বলতেই হচ্ছে, আপনার ক্লাউশ হ্যাটটা লেডি ব্রুকসের মতো।’
মিসেস হিগিন্‌স উল বুনছিলেন, ববের কথায় চেয়ার ছেড়ে কিচেনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতেই হিগিন্‌স চোখের ইশারা করল।
—‘না হে, হবে না। আজ রাতের মতো সব শেষ। ঠিক আছে, নিগ্রো লোকটাকে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে পার তবে আমি ভেবে অবাক হচ্ছি, তুমি নিজেই ওর জন্য খাবার কিনে আনছ না কেন?’
মৃদু স্বরে শাপশাপান্ত করল বব। ঠিক আছে সে না হয় নিজেই খাবারদাবারের বন্দোবস্ত করবে। আপাতত বুড়োটাকে নিজের ঘরে নিয়ে যাওয়া যাক।

বব উইলিস ও একটি কালো কোটের গল্প- পর্ব ১

     গোটা শীতকালটাই বব বেশ ঝিমিয়ে কাটায়। ঘরের জানালা দিয়ে উদাস চোখে বাইরের বরফ পড়া দেখা ছাড়া তার কাজ বলতে শুধু খাওয়া এবং ঘুম। সন্ধ্যার দিকে অবশ্য সে চেস্টারের বিয়ার পাবে কদাচিৎ যায়। কদাচিৎ, কারণ জর্জটাউনের লম্বা চুলওলা মেয়েদের সে দু’চক্ষে দেখতে পারে না। সে জানে তার এই আয়েশি চালচলন বাড়িওয়ালা মিঃ হিগিন্‌সের পছন্দ নয়। তবে যেহেতু সে মাসপয়লা বাড়িভাড়া অন্য ভাড়াটেদের তুলনায় আগে দেয়, এবং প্রাতরাশের টেবিলে মিসেস হিগিন্‌সের লেস দিয়ে বোনা ফ্রেঞ্চ গাউনের প্রশংসা করে, তাই হিগিন্‌স তাকে কিছু বলে না। উপরন্তু মাঝেসাঝে তার জন্য এক বালতি বেশী গরম জল রেখে দেয়। প্রতিদানে, কখনো কখনো সে ক্রাম্যার্স লেন ধরে ব্রডওয়ের দিকে টহল দিতে গেলে, হিগিন্‌স দম্পতির জন্য মিষ্টি রুটিও কিনে আনে। তবে শীতকালে তার প্রথম পছন্দ বেকার্স ইনের কেক। ক্যান্টারবেরির কেকও তার ভালো লাগে তবে ওতে স্ট্রবেরি থাকে না।
     আমাদের গল্পের নায়ক বব উইলিস কোনো ভবঘুরে নয়। সে জর্জটাউন কোলিয়ারীর শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা। অবশ্য এর মানে এই নয় যে সে উডল্যান্ড পার্কে দাঁড়িয়ে, চোঙা হাতে, কোলিয়ারীতে কেন বছরে মাত্র দু’শ চৌত্রিশ দিন কাজ দেওয়া হবে, তার বিরুদ্ধে জোরদার সওয়াল করতে পারে। ওহাইয়ো আর মিসিসিপিতে যে শ্রমিকদের দ্বিগুণ মাইনে দেওয়া হয় এ খবরটাও সে জানে না। যেমন জানে না, হিগিন্‌সের বোনঝি মিস আন্যাবেল মেরী ক্যারোলাইনার দাঁতে ব্রেস রয়েছে। তবুও তাকে ইউনিয়নের নেতা বানানো হয়েছে, তার কারণ মালিকের মেয়ের সাথে তার একটু বেশীই খাতির।
     এমনিতে বব ছেলে ভালো। তার বাপ যখন তাকে হাইস্কুলের পাট চুকিয়ে কোলিয়ারীতে কাজে ঢোকালো তখন সে মোটেই আপত্তি জানায়নি। বরং প্রথম মাইনে পেয়ে সে একটা ছিপ কিনে সাত পাউন্ডের স্যালমন মাছ অবধি ধরতে পেরেছিল। মাসের প্রথমদিকে বন্ধুবান্ধবের পেছনে সে অকাতরে পয়সা ঢালে, যে কারণে বন্ধুরা তাকে খাতির করে ডাকে ‘আমুদে বব’ বলে। তবে তার সবথেকে ভালো লাগে কেন্টাকি ব্যালে থিয়েটার, বিশেষ করে ওর টিকিট মাস্টার বুড়ো বেনসন্‌কে। প্রতি রবিবার গীর্জাতে সে বুড়োর জন্য চুরুট নিয়ে যায়। আরাম করে বেঞ্চে বসে দু’জনে মিলে খোশগল্প করে। উত্তরে হ্যামন্ড শহরে চিংড়ীমাছের ব্যবসা খোলার বুদ্ধিটা বেনসন্‌ই ওকে দিয়েছিলো।
     ইদানীং কোলিয়ারীর অবস্থা খুব খারাপ। টন পিছু মজুরির হিসেব অনুযায়ী শ্রমিকদের যা পাওয়ার কথা তার অর্দ্ধেকও তারা পাচ্ছে না। কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে জ্যাকসনভিল এগ্রীমেন্ট অনুযায়ী কোলিয়ারী নাকি বন্ধ হয়ে যাবে। মজুরি কম পাওয়ায় কেউ আর কাজ করতেও চায় না। পুরোনো বাসিন্দারা সব এক এক করে সম্পত্তি বেচে চলে যাচ্ছে। গত গ্রীষ্মে সার্কাসও তেমন জমেনি। তবে ববের এসবে কিছু যায় আসে না, তার সকাল সন্ধে রুটি আর মদ হলেই চলে যায়।
     আমাদের গল্প শুরু হচ্ছে নভেম্বরের কোনো এক শীতের সন্ধ্যাবেলায় ক্রাম্যার্স লেনের সরাইখানাটির দোতলার এক ছোট্ট জানালা থেকে। ঐ জানালার পাশেই ববের প্রিয় ইজিচেয়ারটি রাখা। ওতে বসে বব একমনে পাশের বাড়ির চুল্লীটার ধীরে ধীরে বরফে ঢেকে যাওয়া দেখছিল। নীচে রাস্তাঘাট একরকম শুনশান। ক্রমশ পশমের তুলোর মতোন হাল্কা ছাইরঙা বরফে সবকিছু ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
     আজ বব সারাদিন প্রায় ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। একবারমাত্র কিছুক্ষণের জন্য সে ইউনিয়নের মাসিক পত্রিকা পড়ার চেষ্টা করছিল। বিশেষ করে, ‘রবিবার সন্ধ্যা’-র কলামটা যেখানে একগুঁয়ে টমাসের বউ নানান মুখরোচক হুজুগের হালহদিস দেয়। এছাড়া সে পড়েছে পাদ্রী সাহেবের গীর্জাসংক্রান্ত নানান ঐশ্বরিক চিন্তাভাবনা, কিংবা শহরের পুরোনো বাড়ি কেনাবেচার গল্প। অবশ্য ইউনিয়নের দাবিসনদ জাতীয় জটিল বিষয় সে ছুঁয়েও দেখেনি। তবে সবকিছুই তার বিরক্তিকর লাগছিল কারণ হ্যামন্ডে মাছের ব্যবসার বাজার কেমন, সেসব কিছুই এইধরনের পত্রিকায় পাওয়া যায় না।
     চুল্লীটার প্রায় পুরোটাই বরফে ঢেকে যাওয়ার পর ববের মনে হল জর্জটাউনে সে অনেককাল কাটিয়ে ফেলেছে। প্রতিসন্ধ্যায় হিগিন্‌সের পিয়ানোর বিরক্তিকর টুংটাং শোনার মতোই শহরটা একঘেয়ে। কোনো নতুনত্ব নেই। এমনকি ব্রডওয়ের ধারে জামাকাপড়ের দোকানের নতুন মালিকের বউও সেই একই মেরি উইডো হ্যাট পরে। বব দ্রুত ঠিক করল শীতের শেষে সে উত্তরের দিকে চলে যাবে। কোনো বন্দরে চাকরি নেবে। খালাসি কিংবা নাবিকের চাকরি হলে বেশ হয়। মাইনেপত্তর ভালো, তাছাড়া একঘেয়েমিটাও কাটবে। তারপর না হয় হাতে পয়সাকড়ি এলে সুবিধামতন টাটকা মাছের ব্যবসা খুলে জাঁকিয়ে বসা যাবে। বন্দর শহরের সুবিধা হল ওগুলো কখনো পুরোনো স্যাঁতস্যাঁতে হয় না।
     এইসব ভেবে বব একটু নড়েচড়ে বসল। সারাদিন ঝিমিয়ে থাকার পর একটু উত্তেজিত হওয়ার মতন রসদ পাওয়া গেছে। আলমারি খুলে সে বার করল উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একটা কাঠের বাক্স। খবরের কাগজের কাটিং, কিছু ডলারের নোট, খুচরো পয়সা, পারফিউমের শিশি ও আরও নানান টুকিটাকিতে যেটা প্রায় ভর্তি। আতিপাতি খুঁজে সে বের করল বহুদিন আগেকার বিজ্ঞাপনের কাটিং। ছোট্ট একফালি বিজ্ঞাপন। বন্দরের কর্মকর্তারা যেমন ডকইয়ার্ডে সাফাই কর্মীনিয়োগের জন্য দায়সারা গোছের নোটিশ লটকায়, অনেকটা সেরকম। বব যত্ন করে সেটাকে থুতু দিয়ে দেওয়ালে সেঁটে বিছানার উপর শুয়ে শুয়ে লক্ষ্য করতে লাগল।
‘এই রকম কিছু একটা আমার দরকার।’, বিড়বিড় করে বলে উঠল সে। ‘অবশ্য মাইনেটাও দেখতে হবে। তবে ঝাড়ুদার হিসেবে চাইলে ওরা বব উইলিসকে পাবে না। নাবিকের কাজই আমি ভাল পারব। হয়তো ওরা আমার কাজ দেখে মেট্‌ও করে দিতে পারে। ওঃ কি তোফা থাকা যাবে! দু’মাস অন্তর নতুন জায়গা, নতুন মদ, ডকইয়ার্ডে নতুন নতুন সব লোকজন, জাহাজঘাটার একপাশে শেডের ভিতর অফিসারদের ক্যান্টিন, দিলদরিয়া মেজাজের শিপমেটের চিৎকার, ‘এই বব, কম্পাস দেখ, নোঙর ফেল,’ টি আং লিং, আ হয় ক্যাপ্টেন, টি আং লিং…’
বব উইলিস পৃথিবীর অন্য সব উচ্চাভিলাষী যুবকের মত নয়, তাই সে এরপর দক্ষিণদেশীয় কোন ধনী মেয়েকে বিয়ে করে কাচ্চাবাচ্চার স্বপ্ন মোটেই দেখল না, বরং ফুর্তির চোটে বোতলটা শেষ করে চটজলদি স্থির করল চেস্টারের পাবে একবার ঢুঁ মারবে। ওখানে আজ বেনসনের আসার কথা। ওর সাথে পরামর্শ করতে হবে।
     বাইরে এখনো ক্রমাগত বরফ পড়ে চলেছে। প্রায়ান্ধকার রাস্তায় দু’ধারের গ্যাসবাতিগুলো এখনো জ্বলেনি। পথচলতি মানুষজন ঠান্ডার চোটে আপাদপমস্তক ঢাকা। গরম জামা, জুতো, মোজা, দস্তানা, টুপি, ওভারকোট চড়িয়ে ঘরের দরজা খুলতেই বব শুনতে পেল একতলায় হিগিন্‌সের বৈঠকখানায় পিয়ানোর রেওয়াজ শুরু হয়েছে।

Tuesday, 13 December 2011

সিন্ডারেলা


লাল সিমেন্টের উঠোন ছিল রসময়ীর
খোয়া খোয়া নদী নালা ওঠা,
শীতল জমিন,
মাটিতে থাবার দেহে
গুয়ের্নিকা টেক্সচার
প্রতিদিন,
হাঁটুভাঁজ কোলকুঁজো
উঠোনে পুড়ত কত
রৌদ্রবীজ, একপাটি রোদ
অসময়ে

এরপর ছাপাখানায় ওরা ছাপল রূপকথা
দুমলাটে, তিন রঙা
ছবি ছবি কথা,
কেউ দিল হাতি,
কেউ দিল ঘোড়া,
শুক-সারি জোড়া জোড়া
স্বাভাবিক ভাবে যৌতুক কিছু 
রক্তমাংসবোধ
রোয়াকে সারি সারি ছত্রাক,

লাল উঠোন ফিরিয়ে দিল
অন্যপাটি রোদ।

Thursday, 29 September 2011

কাপড়ে জানালা নেই

ইউরেকা আবিষ্কারের পর আর্কিমিডিস তো ভাবেননি তিনি নগ্ন।
ওদিকে ওরা প্রত্যেকে ইউরেকা হয়ে নগ্নতা ভেবে চলে।
উদাহরণ,
এদিকে তারকাখচিত রাত আর ওরা দূরে বসে কাঁপে’,
শুধু তাই নয়,
কাপড় চোপড় দিয়ে ঢাকে 
শরীর জুড়ে অসংখ্য উৎসুখ চোখ।
আর প্রতিবার আউড়ে নেয়
ঘুমচোখে, 
হে নিউটন,
পাপ ফের আপেল থেকেই শুরু হোক।

Friday, 23 September 2011

নক্সী কাঁথা মন - ৫


জন্ম জন্মান্তর মানেন? আমি মানি মশাই, সেকারণে ট্রাম দেখলে ভয় পাই। (ইনিশিয়ালি অবশ্য পেতাম না। তারপর অব্যেস হয়ে গেছে।) থিয়সফিক্যাল ব্যাপার-স্যাপারে আমার বেজায় আগ্রহ। মাদাম ব্লাভাৎস্কিকে মাথায় করে রাখি। ফলে বিভিন্ন স্থানে আত্মার অবিনশ্বরতা নিয়ে তুমুল তর্কে যোগদান করি। খালি, ঐ যেবার ঘোতন আঁক কষে দেখাল আত্মা ইকোয়ালটু জিরো, সেদিন অবশ্য একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল। চারটে সেলাই আর চোয়ালে ব্যাথা নিয়ে
যাক গে, মোটকথা আত্মা-ফাত্মা, ভূত প্রেত সাপ ব্যাঙ টিকটিকি এসব নিয়ে আমি খুব সিরিয়াস। আলোচনায় ফিলসফির সাথে থিয়সফি মিশে গেলে তো কথাই নেই। তখন নাকি আমার মাথার পেছনে ফসফরাস মার্কা গ্লো দেখা যায়। আমি অবশ্য এই নিয়ে অর্বাচীনদের ফিসফিসে কান দিই না। জীবনে আধ্যাত্মিকতাই আসল।
এত সব বলার কারণ হল, ব্রাউন প্যাকেটের ঝুলির ভেতর থেকে দ্বিতীয় যে বেড়ালটি বেরোল তার শিরোনামআত্ম চাহিদা। কবিতা নয়। দস্তুরমতো প্রবন্ধ। ফিলসফি ফিলসফি গন্ধ। মনের ভেতর কেমন গদগদ ভাব টের পেলুম। এই হল গিয়ে প্রকৃত প্রবুদ্ধ মনের শিল্পিত ভাস্কর্য। ওইসব কবিতা-ফোবিতা তো ছেলে ছোকরাদের চ্যাংড়া মনের ল্যাঙড়া প্রেম। প্রবন্ধ লেখার জন্য যেবিদগ্ধমন দরকার তা কয়জনার আছে। সেই প্রবন্ধের কীয়দংশ এক্ষণে উদ্ধৃত করিব।

প্রথম অনুচ্ছেদঃ

কী কী করিলে আত্ম তুষ্ট হয় ইহা আমাদিগের আত্মাকে প্রশ্ন করিলে তাহার কি বা কেমন উত্তর হইবে, কী ভাবেই বা তাহার উত্তর দিয়ে থাকিবে সেই সকল সম্মন্ধে কেবল আমাদিগের আত্মাই জ্ঞাত। উপরন্তু ইহা এমনই একনিষ্ঠ প্রকারান্তরের মধ্যম বস্তু হইয়া একস্থানে নতুবা তুষ্টের ত্বরে অন্য কোন স্থানে গমনাগমনে উদবিঘ্ন হইয়া থাকে ইহার চারিত্রিক ত্রুটি বিচ্যুতি বৈচিত্রময়। আবার তাহা ইহাকেই গমনাগমনে উদ্ভিঘ্ন করিয়া চাঞ্চল্য কর এক বিচ্ছিন্ন প্রকৃতি প্রস্তুত করিবার তরে সদা প্রস্তুত। অভিমুখ ত্রুটি ইহার সর্বাপেক্ষা নান্দনিক বিষয় বলিয়া, ইহা অন্তর ধ্যান করিয়া সেই সুচারু অভিমুখে, যেখানে ইহাকেই সকল পাইবে ভাবিয়া থাকে।

না, ভূমিকম্প হয় নি। যা লিখিত ছিল তাহাই বিধৃত করিয়াছি। কিন্তু ভাষার সতেজ ভাবটা লক্ষ্য করেছেন কি! উত্তরের মধ্যেই প্রশ্ন, এবং প্রশ্নের মধ্যেই উত্তরের আত্মগোপনটা দাদাআআআ কেমন সহজ করে বুঝিয়েছেন। এরকম অনেকটা দেখা যায় প্যান আমেরিকান কালচরে বা ইনকাদের পিরামিডের ওপর। প্রথম অনুচ্ছেদ পড়েই মাইরি মনটা গভীর শান্তিতে জুড়িয়ে গেল। চারপাশে টের পেলুম অপার স্নিগ্ধতা জুড়িয়ে এসেছে। মস্তিষ্ক চিরকাল মোর শিরঃপীড়ার প্রধান কারণ, এক্ষণে সেটি জবুথবু হওয়ামাত্র ইন্দ্রিয়াতীত সুখ টের পাইতেছি। ভাবরসে শান্তিপুর ডুবুডুবু। মনে হইল, সত্যই বটে, আত্মা শালা কখন কি করিবে কেমনে জানিব! গেছোদাদার মতো কোথায় রয়েছে তা জানাও না-মুমকিন। বউয়ের বেহিসেবি বলিয়া তিরষ্কার, প্রকৃতপক্ষে ঐ নান্দনিক বিষয়। মূর্খ স্ত্রীলোক, না বুঝিয়াই প্রশংসা করিয়া ফেলিয়াছে। যাহা হউক, পরের অনুচ্ছেদে কি রহিয়াছে?

যাহারা ইহাকে একান্ত ভাবেই আপন করিয়া লইয়াছে তাহারা জীবনে ইহার হস্ত যূপকাষ্ঠে বলি হইয়া নিঃশেষ হইয়া গিয়াছে। ইহাও একটি ইহার বৃহৎ বৈশিষ্ট্য। ইহা কাহাকেও পর বলিয়া ভাবিয়া থাকে না। অপরকে আত্মহনন পূর্বক ইহা সবারে আপন করিয়া নিজ নিজ রুটে টানিয়া লয়। আর যাহাদের ইহার ত্বরে দূর্বলতা থাকিয়া থাকে তাহাদিগের তো কথাই নাই।

ব্যস্‌, হয়ে গেল। স্বল্পক্ষম মানব আমি, ‘আমাদিগেরআর কি কথাই বা থাকবে। ইহাই তো ইহার বৈশিষ্ট্য। আপ্তবাক্য শুনে ভীষণরকম ঘেমে গেলুম। অনেকটা সেই প্যালারামের বাঘের গর্তে পড়ার পরের দশাটুকুর মতো। গর্তের মধ্যে আমি, বাঘ, শজারু আর দাদাআআআ। আমি শজারুকে আত্মহনন করছি, শজারু বাঘকে, বাঘ দাদাআআআ কেপ্রত্যকেই নিজেদের রুটে একে অন্যকে টানছি। আয় আয়, বেলেঘাটা ডায়মন্ডহারবার রানাঘাট তিব্বত। কিন্তু কেউ আসছে না। আসবে কি করে, সকলেই তো যূপকাষ্ঠে রয়েছে, মায় শজারুটা অবধি। শিহরিত হয়ে ভাবছি বৃথাই এ জীবন, মিথ্যেই এ স্তোকবাক্য, কি আর হবে, যাই গিয়ে এগরোল খাই। অমনি দাদাআআআ-র সাবধানবাণী,

যাহারা অত্যন্ত বেশী খাইয়া থাকে, তাহাদিগকে উদর পূর্ত করিয়া খাওয়াইলেও যেমন তাহাদিগের মনঃপুত হয়না, নিন্দুকদিগের পশ্চাদে অতি কঠিন কৃচ্ছসাধন করিয়া থাকিলেও নিন্দা ও ভর্তসনা শুনিতে হয়, তেমনই ইহার প্রতি যতই উৎসর্গ করিয়া থাকিলেও অন্তঃদিন পর্যন্ত ইহা চাহিয়া থাকিবে।

ভেঙে পড়লুম। হতভাগা পেট! ক্রমাগত পেটের দিকে চাহিয়া বসিয়া থাকাই সার। খালি খাও খাও, দাও দাও। ভর্তসনা শুনে সোনা মুখে বগল বাজাও। বঙ্কিমচন্দ্র এজন্যই বলেছিলেন, ‘আহার নিদ্রা ও মৈথুন। এ চলতে পারে না। পলিটব্যুরো নাকি? গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা থেকে বেরোতে হবে। কিন্তু গুরু কই? সাধন কি প্রকারে?

বন্ধুরা ও শুভানুধ্যায়ীরা এসে পরামর্শ দিল, ‘তুমি বরং একবার দাদাআআআর সাথে দেখা করো।

নক্সী কাঁথা মন - ৪


প্রথমে একটি কবিতা। কবিতার নামঘুর্নিপাক। হ্যাঁ, ভাষা ও বানান অপরিবর্তিত রেখেই আপনাদের তা শোনাচ্ছি। প্রথম অনুচ্ছেদটি শ্রবণ করুন,

গ্রহরা ঘোরে,সূর্যের চারিধারে।
পৃথিবী ঘোরে,সর্যকে কেন্দ্র করে।
চন্দ্র ঘোরে,পৃথিবীকে কেন্দ্র করে।

এই অবধি শুনে নিশ্চয়ই ভাবছেন, এ নিছক সৌরজগতের কবিতা নয়।দাদাআআআ’-র মহিমা অনুযায়ী এই কবিতার মাধ্যমে উনি হয়তো জীবনের একঘেয়েমির এন্টিক্লকওয়াইজ আবর্তনকে বোঝাতে চেয়েছেন। কি নিদারুণ একঘেয়েমি। তাই তো সেকেন্ডটাইম সূর্য বানানে দীর্ঘ ঊ নেই। ওটা এই একঘেয়েমির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। বস্তুতঃ সে হিসেবে এটি আসলে পাশ্চাত্যের ভিক্টোরিয়ান যুগের সংস্কারের বিরুদ্ধে সুপষ্ট ক্লকওয়াইজ হ্রেষারব। আম্মো এই ভেবেছিলুম। কিন্তু ফোর্থ লাইনে একটি পাঞ্চ রয়েছে।

গরুরা ঘোরে,তাদের বোকামির তরে।

ব্যস্‌, ঘেঁটে গেলুম। কাকে বলছে রে বাবা? বন্ধুরা উপদেশ দিল, হে কৌন্তেয়, প্রথম চারলাইনেই কবিতার মূল ভাব ফুটিয়ে তুলতে হবে এ কেমন মৌলবাদ। রথে চড়, আগে বাড়। তাই ত্রস্ত অবস্থা চট করে কাটিয়ে উঠে বাকিটুকুর দিকে চোখ রাখলুম

বিজ্ঞানীরা ঘোরে, মহাকাশকে কেন্দ্র করে
ভগবান গণেশ ঘোরে, তার দাদার তরে।
সৈনিকেরা ঘোরে, যুদ্ধের তরে।
ক্যাসেট ঘোরে,মানুষকে খুশি করার তরে।

হুঁ হুঁ কেমন বুঝছেন? প্রথম তিনটি উপমা দেখুন। কি নিদারুণ প্রাণময় বাস্তব, যেখানে পুরাণ ও আধুনিকতা একসাথে মিশছে। হালার মানবসমাজ এই সকরুণ ঘোরাঘুরি, কেমন জড়বস্তুর মধ্যেও ছড়িয়ে দিয়েছে। ক্যাসেটকে পর্যন্ত মানুষের অন্তহীন এন্টারটেনমেন্টের জন্য ঘুরতে হয়। চোখে জল চলে আসে মশাই। ভাবুন, সামান্য ক্যাসেটকে পর্যন্ত লোভী মানুষেরা

চোরেরা ঘোরে,চুরি করার তরে।
পুলিশেরা ঘোরে, চোরেদের ধরার তরে।

এ একদমই সত্য কথা। খাদ নেই। কবিরা সত্যদ্রষ্টা। যা দেখছেন, তাই লিখতে হবে। মনে করে দেখুন, ‘আমাদের ছোট নদী, চলে আঁকেবাঁকে, বৈশাখ মাসে সেথা হাঁটুজল থাকে।সুতরাং হাঁটুজল থাকলে তাই লিখতে হবে। এই প্যাটার্নটা হল, কবিতার মাঝে সামান্য গ্যাপ দিয়ে জিরিয়ে নেওয়ার জন্য। কবির কল্পনায় ভর দিয়ে উড়তে গিয়ে যাতে গোঁৎ না খেয়ে যান, সেজন্য। মনে সশ্রদ্ধ ভাব এল। এইরকম এত সুন্দর করে এক্সপেরিমেন্ট! এছাড়া এ কবিতার বাকিটুকু নেহাতই রিমেমব্রেন্স অভ্‌ কারেন্ট সিস্টেম, যথা

শিক্ষকেরা ঘোরে,শিক্ষা দেওয়ার তরে।

মনে প্রশ্ন জাগল? ছাত্রেরা তাহলে কি করে? সহজ উত্তর

ছাত্রেরা ঘোরে,শিক্ষা নেওয়ার তরে।

এমন আরো আছে। যথা
বাপেরা ঘোরে,ছেলেমেয়েদের তরে।

আরো একটি সাংঘাতিক উপমা। স্রেফ লিটারেল মিনিং ধরলে চলবে না। বাপ মানে কি? স্রেফ অন্নদাতা? বিগার সেন্সে ধরুন। গোটা পৃথিবীই তো একাধারে আমাদের বাপ মা। আমরা তো তারই সন্তান। ধরিত্রীপুত্র। কারেন্ট কন্টেক্সটে টোটাল মা মাটি মানুষ। তো, সে না ঘুরলে আমরা সব শালা ছিটকে মহাকাশে গিয়ে তুশ্চু। তো, আমাদের তরে সে ঘুরছে আর আমরা দিব্যি ভাবছি যে ঘুরছে না, এ হলো মানুষের চিরকালীন লোকালি ডিফিওমর্ফিক শ্রেনীচেতনা ওরফে স্বার্থপরতার গল্প। ব্যাপারটা ডিকেন্স পড়লে আরো বেশী করে বোঝা যাবে। সহজে বোঝানো যাবে না। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে ছেলেমেয়েদের উপর আলোকপাতটি কোথায়? তাও আছে

ছেলেমেয়েরা ঘোরে,তাদের প্রেমিকপ্রেমিকার তরে।

ব্যাখ্যা নিস্প্রয়োজন। তবু জানতে চাইলে ঝোপে ঝাড়ে খোঁজ করুন।

এ কবিতায় আরো কিছু ছিল, সেগুলো মেটামরফোসিস ওফ সামথিং এলস। আমি সামলাতে পারিনি। ধপাস করে পড়ে গেছিলাম। আমার মন্ত্রীপারিষদদের অবস্থাও তদ্রুপ। এমনকি ঘরের ইলেকট্রিকের ল্যাম্পটিও পারেনি। অনতিবিলম্বে আঁধার নামিয়াছিল।

নক্সী কাঁথা মন - ৩


আঃ, গপ্পো বলার সময় হুড়ো দিতে হয় না। রসিয়ে রসিয়ে পাঁপড়ভাজা সমেতযাক গে্‌ সে আর পাবো কোথায়, তা তাপ্পর কি হোলো শুনুন। নির্দিষ্ট সময়ে নোটিস লটকানো হল। বয়ান কিছুটা এইরূপ, হে পান্থশালার ভাইবোনেরা, তোমরা গল্প কবিতা নাটক রম্যরচনা ছড়া কবিতা নাচ গান আঁকা জোকা যা খুশি আমাদের পাঠিয়ে উদ্ধার করো। খালি খিস্তি খেউড় বাদ। আমরা সেই সুরম্য কদলীসমূহ ম্যাগাজিনে গ্রন্থিত করে নিদারুণ আনন্দ বিতরণ করি।
অবশ্যই আমাদের শ্রেনীসচেতনতা আছে। যাঁরা স্মিতশুভ্র গুরুদেব, বুর্জোয়া ইন্টেলেকচুয়াল আপেলে সর্বদা নিমজ্জিত, তাঁদের করজোড়ে বলা হল, ভো অজ্জউত্ত, মেল দ্বারা নিমন্ত্রণের ত্রুটি মার্জ্জনীয়। স্বগুণে ক্ষমা ঘেন্না করে দিন এবং স্ব স্ব লেখনীগুণে আমাদের ঐশ্বর্যমন্ডিত করুন। যাঁরা সামান্য তরুণ প্রলেতারিয়েত, সবে পাকছেন, তাঁদের বলা হল, শোনো ভাই, যদি গুটিকতক নারী পটাতে চাও তো শিগগির কিছু কবিতা জমা দাও। খবরদার, অন্য কিছু জমা দেওয়ার চেষ্টা করবে না। আর যেগুলো ঐ তিনের বার, মানে লুম্পেন প্রলেতারিয়েত, তাদের জন্য ছড়া ইত্যাদির স্ট্রং ফরমায়েশ জাহির করা হল। এবং এই সমস্ত কর্মকান্ড শেষে আমরা নিশ্চিন্ত মনে গাঢাকা দিলুম।

দেখতে দেখতে মাসাধিককাল অতিবাহিত। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল যে কেউই কিচ্ছুটি জমা দেয় নি। মায় কোন ট্যাঁফো অবধি নেই। অন্যান্যবার এমনসময় শোনা যায় অমুক হোস্টেলে আরেকটি মেঘনাদবধ কাব্য রচিত হচ্ছে, কি তমুক হোস্টেলেসাবঅল্টার্ন সিনেমা, গোদার ও বেখাপ্পা ক্যামেরা আন্দোলনজাতীয় থিসিস জন্ম নিচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এবার সব চুপচাপ। একেবারে নিবাত নিশ্চুপ নেই মামা ভাব। সকলে চিন্তিত হয়ে পড়লাম। হলো কি এদের?

এই ফাঁকে বলে নিই, প্রত্যেক রাজার যেমন একটি অমাত্য পরিষদ থাকে, আমারও তেমন ছিল। এবং এই অমাত্য পরিষদরা যেমন বিক্রমাদিত্যের আমল থেকেই রাজকার্য সম্পন্ন করে এসেছে, এখানেও তার ব্যাত্যয় হচ্ছিল না। কিন্তু তারাও এবার ফাঁপরে পড়ে গেল। মনে মনে অবশ্য সকলেই আশা করে আছে যে সেনসেক্স আবার ঘুরবে। হাজার হোক, বঙ বলে কথা। চাট্টি গপ্পো কবিতা পাওয়া যাবে না! ছোঃ।
কিন্তু ঐ আশাটাই সার। তারিখ পেরিয়ে গেল, কিস্যুটি পাওয়া গেল না। তারিখ এক্সটেন্ড করা হল, ক্যাম্পেন চালানো হল, মায় ঘুষ অবধি দেওয়া হতে লাগল, তবু কিস্যু নেই। সন্দেহ হল, দেবী কি হাঁসের পরিচর্যা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত? কারোর ওপর ভর করছেন না যে বড়! নাকি এ এক সর্বব্যাপী চক্রান্ত! কার পাকা ধানে মই দিলুম রে বাবা। যাইহোক, নানাপ্রকার কন্সপিরেসি থিয়োরীতে যখন ভগবান দশচক্রে ভূত হইতেছেন তখন পেয়াদা আসিয়ে ঘোষণা করিল, ‘হারাধনের একটি ছেলেরে পাওয়া গিসে।সক্কলে হামলে পড়লাম।
পেয়াদার হাতে একটি ব্রাউন প্যাকেট। স্থূলকায়, স্ফিতোদর। প্যাকেট টি পাঠিয়েছেন কে? কে আবার, আমাদের মহামহিম দাদাআআআ। ম্যাগাজিনকে বাস্পীভূত হওয়ার দশা থেকে বাঁচাতে উনি নিজেই ওঁর রচনাবলী পাঠিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গে অনুরোধ, সবকটি লেখা ছাপালেই ভালো হয় তবে আমরা যদি সৌজন্যতা বশতঃ কিছু বাদও দিই, তাহলেও উনি অখুশি হবেন না। এঁর মধ্যে কিছু লেখা আবার স্বর্ণপদকজয়ী। তো, সেই গুণীশ্রেষ্টদের উপস্থিতি উনি একান্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন। রিগার্ডস...ইত্যাদি। পেয়াদা প্রস্থান করিল।
দিনটা এখনো মনে আছে। নোংরারকম বৃষ্টি হচ্ছে। প্রায়ান্ধকার ঘরে আমরা গুটিপাঁচেক বসে এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছি। সামনে জলজ্যান্ত বারুদ। কেউই নেড়েচেড়ে দেখার সাহস পাচ্ছি না। শেষে আর থাকতে না পেরে বাতি জ্বালিয়ে প্যাকেট উন্মোচন করলুম। একতাড়া ফুলস্কেপ কাগজ বার হল।