Friday, 23 September 2011

নক্সী কাঁথা মন - ৪


প্রথমে একটি কবিতা। কবিতার নামঘুর্নিপাক। হ্যাঁ, ভাষা ও বানান অপরিবর্তিত রেখেই আপনাদের তা শোনাচ্ছি। প্রথম অনুচ্ছেদটি শ্রবণ করুন,

গ্রহরা ঘোরে,সূর্যের চারিধারে।
পৃথিবী ঘোরে,সর্যকে কেন্দ্র করে।
চন্দ্র ঘোরে,পৃথিবীকে কেন্দ্র করে।

এই অবধি শুনে নিশ্চয়ই ভাবছেন, এ নিছক সৌরজগতের কবিতা নয়।দাদাআআআ’-র মহিমা অনুযায়ী এই কবিতার মাধ্যমে উনি হয়তো জীবনের একঘেয়েমির এন্টিক্লকওয়াইজ আবর্তনকে বোঝাতে চেয়েছেন। কি নিদারুণ একঘেয়েমি। তাই তো সেকেন্ডটাইম সূর্য বানানে দীর্ঘ ঊ নেই। ওটা এই একঘেয়েমির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। বস্তুতঃ সে হিসেবে এটি আসলে পাশ্চাত্যের ভিক্টোরিয়ান যুগের সংস্কারের বিরুদ্ধে সুপষ্ট ক্লকওয়াইজ হ্রেষারব। আম্মো এই ভেবেছিলুম। কিন্তু ফোর্থ লাইনে একটি পাঞ্চ রয়েছে।

গরুরা ঘোরে,তাদের বোকামির তরে।

ব্যস্‌, ঘেঁটে গেলুম। কাকে বলছে রে বাবা? বন্ধুরা উপদেশ দিল, হে কৌন্তেয়, প্রথম চারলাইনেই কবিতার মূল ভাব ফুটিয়ে তুলতে হবে এ কেমন মৌলবাদ। রথে চড়, আগে বাড়। তাই ত্রস্ত অবস্থা চট করে কাটিয়ে উঠে বাকিটুকুর দিকে চোখ রাখলুম

বিজ্ঞানীরা ঘোরে, মহাকাশকে কেন্দ্র করে
ভগবান গণেশ ঘোরে, তার দাদার তরে।
সৈনিকেরা ঘোরে, যুদ্ধের তরে।
ক্যাসেট ঘোরে,মানুষকে খুশি করার তরে।

হুঁ হুঁ কেমন বুঝছেন? প্রথম তিনটি উপমা দেখুন। কি নিদারুণ প্রাণময় বাস্তব, যেখানে পুরাণ ও আধুনিকতা একসাথে মিশছে। হালার মানবসমাজ এই সকরুণ ঘোরাঘুরি, কেমন জড়বস্তুর মধ্যেও ছড়িয়ে দিয়েছে। ক্যাসেটকে পর্যন্ত মানুষের অন্তহীন এন্টারটেনমেন্টের জন্য ঘুরতে হয়। চোখে জল চলে আসে মশাই। ভাবুন, সামান্য ক্যাসেটকে পর্যন্ত লোভী মানুষেরা

চোরেরা ঘোরে,চুরি করার তরে।
পুলিশেরা ঘোরে, চোরেদের ধরার তরে।

এ একদমই সত্য কথা। খাদ নেই। কবিরা সত্যদ্রষ্টা। যা দেখছেন, তাই লিখতে হবে। মনে করে দেখুন, ‘আমাদের ছোট নদী, চলে আঁকেবাঁকে, বৈশাখ মাসে সেথা হাঁটুজল থাকে।সুতরাং হাঁটুজল থাকলে তাই লিখতে হবে। এই প্যাটার্নটা হল, কবিতার মাঝে সামান্য গ্যাপ দিয়ে জিরিয়ে নেওয়ার জন্য। কবির কল্পনায় ভর দিয়ে উড়তে গিয়ে যাতে গোঁৎ না খেয়ে যান, সেজন্য। মনে সশ্রদ্ধ ভাব এল। এইরকম এত সুন্দর করে এক্সপেরিমেন্ট! এছাড়া এ কবিতার বাকিটুকু নেহাতই রিমেমব্রেন্স অভ্‌ কারেন্ট সিস্টেম, যথা

শিক্ষকেরা ঘোরে,শিক্ষা দেওয়ার তরে।

মনে প্রশ্ন জাগল? ছাত্রেরা তাহলে কি করে? সহজ উত্তর

ছাত্রেরা ঘোরে,শিক্ষা নেওয়ার তরে।

এমন আরো আছে। যথা
বাপেরা ঘোরে,ছেলেমেয়েদের তরে।

আরো একটি সাংঘাতিক উপমা। স্রেফ লিটারেল মিনিং ধরলে চলবে না। বাপ মানে কি? স্রেফ অন্নদাতা? বিগার সেন্সে ধরুন। গোটা পৃথিবীই তো একাধারে আমাদের বাপ মা। আমরা তো তারই সন্তান। ধরিত্রীপুত্র। কারেন্ট কন্টেক্সটে টোটাল মা মাটি মানুষ। তো, সে না ঘুরলে আমরা সব শালা ছিটকে মহাকাশে গিয়ে তুশ্চু। তো, আমাদের তরে সে ঘুরছে আর আমরা দিব্যি ভাবছি যে ঘুরছে না, এ হলো মানুষের চিরকালীন লোকালি ডিফিওমর্ফিক শ্রেনীচেতনা ওরফে স্বার্থপরতার গল্প। ব্যাপারটা ডিকেন্স পড়লে আরো বেশী করে বোঝা যাবে। সহজে বোঝানো যাবে না। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে ছেলেমেয়েদের উপর আলোকপাতটি কোথায়? তাও আছে

ছেলেমেয়েরা ঘোরে,তাদের প্রেমিকপ্রেমিকার তরে।

ব্যাখ্যা নিস্প্রয়োজন। তবু জানতে চাইলে ঝোপে ঝাড়ে খোঁজ করুন।

এ কবিতায় আরো কিছু ছিল, সেগুলো মেটামরফোসিস ওফ সামথিং এলস। আমি সামলাতে পারিনি। ধপাস করে পড়ে গেছিলাম। আমার মন্ত্রীপারিষদদের অবস্থাও তদ্রুপ। এমনকি ঘরের ইলেকট্রিকের ল্যাম্পটিও পারেনি। অনতিবিলম্বে আঁধার নামিয়াছিল।

No comments:

Post a Comment